ঢাকা, সোমবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

যেভাবে ১০ দিনে পাল্টে গেল মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি

রকিবুল সুলভ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:২৭, জুন ২৩, ২০২৫
যেভাবে ১০ দিনে পাল্টে গেল মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি

ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা, ইরানের পাল্টা প্রতিশোধ, এবং সেই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অনুপ্রবেশ—মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতা একরকম বদলে দিয়েছে এবং বিশ্ব রাজনীতির গতিপথে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, যুদ্ধবিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা— নানা ধরনের সামরিক প্রযুক্তি এই সংঘাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ইরানকে বিপর্যস্ত করতে চাইলেও, ইরান সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধের অঙ্গীকার করেছে।

১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা শুরু করে। এই হামলায় কয়েকজন প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ও শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়, যা ইরানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়।

পাল্টা জবাবে ইরান ইসরায়েলের ওপর শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে, যা ইসরায়েলের বহুস্তরীয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ছিন্ন করে। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার তীব্র ধারা শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলেও, পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন। একপর্যায়ে তিনি ইরানের প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দেন।

কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই মার্কিন সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামের অভিযানে ইরানের ফোর্দো, ইস্পাহান ও নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ভয়াবহ বোমাবর্ষণ চালায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, এই হামলায় উল্লিখিত স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ হয়েছে। ইরান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের সময় শেষ ঘোষণা করে এবং পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারি দেয়। অন্যদিকে, ইসরায়েল দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে।

ইরানে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে আরব দেশগুলো, চীন ও রাশিয়া সহ বিভিন্ন পরাশক্তি তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মার্কিন হামলায় কয়েকশ মানুষ নিহত ও এক হাজারের বেশি আহত হয়েছেন।

অপরদিকে, ইসরায়েলে ইরানের হামলায় অন্তত দুই ডজনের মতো নিহত এবং কয়েকশ আহত হয়েছে। সামরিক সূত্র দাবি করেছে, তারা ইরানের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। পাল্টা হামলায় ইরান ইসরায়েলের তেল আবিবসহ অন্যান্য শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পূর্বে মার্কিন বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমানগুলো গুয়ামের দ্বীপপুঞ্জে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে জল্পনা ছিল যে, এসব বিমান ইরানে হামলায় ব্যবহার করা হতে পারে। অবশেষে শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালায়, যা সিচুয়েশন রুম থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যবেক্ষণ করেন।

ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে, ফোর্দো, নাতানজ ও ইস্পাহানে মার্কিন বিমান হামলা হয়েছে। কোম প্রদেশের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইস্পাহানের উপ-গভর্নর বলেছেন, নাতানজ ও ইস্পাহানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর আশেপাশে হামলা হয়েছে। তবে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, এসব স্থাপনাগুলো আগেই খালি করা হয়েছিল, তাই ব্যাপক তেজস্ক্রিয় ক্ষতি হয়নি।

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ দাবি করেছেন, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফোর্দো পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনার এলাকায় ছয়টি নতুন গর্ত তৈরি হয়েছে, যা মার্কিন বোমা হামলার ফল। তবে এখনো ওই এলাকায় কোনো তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়নি।

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস ঘোষণা দিয়েছে, তারা ওয়াশিংটনকে এমন জবাব দেবে, যাতে মার্কিন প্রশাসন ‘অনুশোচনা করতে বাধ্য’ হবে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সও সতর্ক করেছেন, ইরান পাল্টা হামলা চালালে ‘অপ্রতিরোধ্য শক্তির মুখোমুখি’ হবে।

মার্কিন হামলার পর ইরানের কর্মকর্তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা ইরানকে এই প্রণালী বন্ধ না করার জন্য রাজি করাতে সাহায্য করে।

শনিবার ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান, বিমান বাহিনীর জেনারেল ড্যান কেইন বলেছেন, হামলার চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে সময় লাগবে, তবে প্রাথমিকভাবে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, তবে জানিয়েছে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ হবে না। ইরান ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, হামলার পর ওই তিন স্থানে কোনো তাত্ক্ষণিক তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়নি।

ফোর্দোর পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত। মার্কিন বাহিনী সেখানে বিশেষ ধরনের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ব্যবহার করেছে, যা মাটি ভেদ করে বিস্ফোরণ ঘটায়। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এই বোমা ও নিক্ষেপে সক্ষম স্টিলথ বোমারু বিমান কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে।

হামলার পর ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইরান যদি মার্কিন বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।

ইরানে মার্কিন বিমান হামলায় অন্তত ১১ জন আহত হয়েছেন, যাদের কেউ গুরুতর অবস্থায় নেই এবং সাতজন ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান পিরহোসেইন কুলিভান্দ জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলায় তাদের অন্তত তিনজন উদ্ধারকর্মী নিহত হয়েছেন এবং সংস্থার একটি হেলিকপ্টারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মার্কিন হামলার পর ইরান শনিবার রাত ও রোববার ভোরে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এতে ৮০ জনের বেশি আহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই হালকা আঘাত পেয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মার্কিন সামরিক শক্তি ব্যবহারে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তিনি এটিকে ‘বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্ব নেতারা পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।

গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে— যা সাধারণ মানুষ, পুরো অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উত্তেজনা প্রশমনের আবেদন জানিয়েছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কায়া কাল্লাস বলেছেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না, তবে তিনি সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি সবাইকে আহ্বান জানাই এক ধাপ পেছনে সরিয়ে আলোচনায় ফিরে আসার জন্য এবং উত্তেজনা বাড়ানোর পথ বন্ধ করার জন্য।

কায়া কাল্লাস সোমবার ব্রাসেলসে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট ইইউ’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন, যেখানে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শীর্ষ আলোচ্য বিষয় হিসেবে থাকবে।

ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা আগেই যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে লোহিত সাগরে হামলার হুমকি দিয়েছিল। এখন তারা অন্যান্য মুসলিম দেশকে ‘জায়নিস্ট-মার্কিন ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছেন, ইরানে হামলা হলে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হবে। তিনি বলেছেন, হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক জ্ঞান ধ্বংস করা যাবে না।

মার্কিন হামলার পর সোমবার আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জরুরি বৈঠক ডেকেছে। এদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পর রোববার ইরানজুড়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কয়েক ডজন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে। এর আগে মার্কিন বিমান হামলার পরই ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ইরানে এই হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলি বিমান বাহিনী জানিয়েছে, সকালেই ৩০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের ইয়াজদ, ইসফাহান, বুশেহর ও আহভাজের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। প্রথম দফায় নিশানা করা হয় ইয়াজদ অঞ্চলের একটি কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র সদরদপ্তর। হামলায় ৬০টির বেশি যুদ্ধাস্ত্র ও বোমারু বিমান ব্যবহার করা হয়।

ইরানের ইয়াজদ প্রদেশে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নয়জন নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সাতজন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ও দুইজন সেনা সদস্য রয়েছেন। হামলা দুটি সামরিক স্থাপনায় সংঘটিত হয়েছে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।