ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর এখন পুরো বিশ্বের নজর তেহরানের দিকে। ইসরায়েলের সঙ্গে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতে হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা বা বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জলপথ বন্ধের কথা ভাবছে। প্রতিটি বিকল্পই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি ইরানের জন্যও এতে ঝুঁকি রয়েছে।
মার্কিন হামলার জবাবে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় তাদের মিত্রদের সক্রিয় করতে পারে। এই মিত্ররা অতীতে বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে।
ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ছিল লেবাননের হিজবুল্লাহ, কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় সংগঠনটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও হয়তো হিজবুল্লাহকে কাজে লাগাতে পারে তেহরান।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি সামরিক স্থাপনা আছে, যার মধ্যে আটটি স্থায়ী ঘাঁটি। ১৩ জুন পর্যন্ত সিএফআরের হিসাব, প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছে।
গত বছরের শেষ দিকে ইরাকে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য ছিল। ইরানি হামলার ঝুঁকি তাদের ওপরও রয়েছে। ২০২০ সালে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শতাধিক মার্কিন সেনা আহত হয়েছিল।
সিএনএনের বিশ্লেষক বারাক রাভিদ বলেন, ইরান আগে থেকেই হুমকি দিয়ে এসেছে—যদি যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হয় এবং তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ও স্বার্থের ওপর পাল্টা হামলা চালাবে।
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাও বলছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নানা স্বার্থের ওপর হামলা বাড়াবে। হুতির এক শীর্ষ নেতা বলেন, মার্কিন হামলার দায় ট্রাম্পকে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান জানে, সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা কঠিন। তাই তারা দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে প্রতিপক্ষের মনোবল ভাঙতে চাইতে পারে।
ইসরায়েলের হামলার পর থেকে ইরান চাইছিল উপসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্যিক নৌ চলাচলের ওপর প্রভাব ফেলতে। এখন সেই সম্ভাবনা আরও প্রকট হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে পারে।
তেহরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। এই প্রণালী বন্ধ না করার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সহায়তা চাইছে, কারণ চীন এখান দিয়ে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে।
ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধের একটি প্রস্তাব পাস করেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পাশাপাশি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেন, চীনের উচিত ইরানকে বলার, যেন তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ না করে। তিনি বলেন, ইরান যদি প্রণালী বন্ধ করে, তাহলে সেটা হবে তাদের জন্য ভয়াবহ ভুল এবং অর্থনৈতিক আত্মঘাত।
হরমুজ প্রণালী পারস্য উপসাগরকে মুক্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস পরিবহনের প্রধান পথ। মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যে, প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই পথ দিয়ে যায়। এটিকে ‘বিশ্বের জ্বালানির লাইফলাইন’ বলা হয়।
এই পথ বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বেড়ে যাবে এবং চীন, ভারত, জাপানের মতো বড় আমদানিকারক দেশগুলো বড় ধরনের বিপদে পড়বে। এমনকি ইরানের নিজের তেল রপ্তানিও এই পথের ওপর নির্ভরশীল। তাই পথ বন্ধ করা ইরানের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অ্যাড হার্স বলেন, প্রতিদিন প্রায় ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল হরমুজ প্রণালী দিয়ে যায়। এই পথের বিকল্প নেই।
মার্কিন হামলার পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম শুরুর দিকে তিন শতাংশের বেশি বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৭৯ ডলার ছাড়িয়েছে। সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় এই দাম বেড়েছে। এশিয়ার শেয়ারবাজারেও অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
ইরানের কট্টরপন্থী কায়হান পত্রিকার সম্পাদক হোসেইন শারিয়তমাদারি বলেন, ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর এখন পালা আমাদের।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মার্কিন হামলার পর ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে দ্রুত এগোবে। এমনকি বর্তমান শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন হলেও নতুন নেতৃত্ব এই পথে অগ্রসর হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পার্সি বলেন, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, বিশেষ করে যদি শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়।
তিনি বলেন, নতুন নেতৃত্ব হয়তো আগের চেয়ে কঠোর হবে এবং পারমাণবিক অস্ত্রকেই নিজেদের নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা ভাববে। ইসরায়েলি হামলার সময় ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছে। তবে ইরান সবসময় বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ কাজে ইউরেনিয়াম মজুত করছে।
মার্কিন হামলার পর ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারবিরোধী চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে যেতে পারে, যেখানে তারা অস্ত্র তৈরি না করার অঙ্গীকার করেছিল।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক আলি ভেইজ বলেন, ইরানের জবাব শুধু সামরিক প্রতিশোধেই সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। তারা এনপিটি থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জবাবে ইরানের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল ইসরায়েলের ওপর হামলা। তেল আবিবের কিছু ভবনে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে। ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এতে ৮৬ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান হয়তো মনে করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যেতে পারবে না। রোববারের হামলার পর ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকবে বলেই তারা ধরে নিচ্ছে। তাই আপাতত ইসরায়েলের ওপরই হামলা চালিয়ে যাবে ইরান।
আমওয়াজ নিউজের সম্পাদক এবং ইরান বিশ্লেষক মোহাম্মদ আলী শাবানি বলেন, ২০২০ সালে ইরানি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি হত্যার সময় ট্রাম্প যেমন কৌশল নিয়েছিলেন, এবারও হয়তো তেমনটা করবেন।
শাবানি বলেন, ট্রাম্প তখন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান দেখাতে চেয়েছিলেন, বড় বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিস্তৃত যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিলেন। এবারও হয়তো তেমন হবে।
ইরানও হয়তো সম্মান রক্ষার প্রতিশোধ নেবে, তবে সেটা হতে পারে রক্তপাতহীন প্রতিক্রিয়া। যেমন ২০২০ সালে তারা ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছিল, যেখানে কেউ মারা যায়নি, শুধু কয়েকজন ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরিতে (মস্তিষ্কে আঘাত) আক্রান্ত হয়েছিল।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান হয়তো অসম প্রতিক্রিয়ার পথে যেতে পারে। যেমন— সশস্ত্র হামলা বা সাইবার আক্রমণ। ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় ইরানের সামরিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
সিএনএনের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ডেভিড স্যাঙ্গার বলেন, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এখন হিসাব করছে তাদের হাতে কী কী সামর্থ্য অবশিষ্ট আছে, কারণ তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে।
তিনি বলেন, আইআরজিসি হয়তো এখন কিছুটা সতর্ক থাকবে এবং এমন কৌশল বেছে নেবে। যেমন— সাইবার হামলা বা সশস্ত্র আক্রমণ, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র সহজে প্রতিরোধ করতে পারবে না।
একাডেমি সিকিউরিটিজের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রধান এবং সাবেক মেজর জেনারেল জেমস ‘স্পাইডার’ মার্কস বলেন, ইসরায়েল ইরানের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার ধ্বংস করতে পেরেছে। তবে সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আইআরজিসির এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের এমন সব সামর্থ্য রয়েছে, যা এই অঞ্চলের ভেতরে এবং বাইরেও বিদ্যমান। আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) এখন বিশ্বের অনেক জায়গায় ঝুঁকির মধ্যে আছি, যেখানে আইআরজিসির প্রভাব আছে বা যেখানে তারা হঠাৎ করে হামলার মতো কিছু ঘটাতে পারে।
মার্কিন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের বিশ্বব্যাপী সতর্ক থাকতে বলেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে, ইরানের হামলার প্রতিশোধ ও প্রতিবাদের ঝুঁকি রয়েছে। তাই মার্কিন নাগরিকদের বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ইরান এখনো আলোচনার টেবিলে ফিরতে রাজি হয়নি। রোববার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কূটনীতির সুযোগ কতটা আছে, তা এখন অনিশ্চিত। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। তাই আত্মরক্ষার বৈধ অধিকার থেকে জবাব দিতেই হবে।
বিশ্লেষক ত্রিতা পার্সি বলেন, ইরান নিজেদেরই কোণঠাসা করে ফেলেছে। তাদের লক্ষ্য ট্রাম্পকে বাধ্য করা যেন তিনি নেতানিয়াহুর যুদ্ধ থামান এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ দেন। তবে বিপরীত দিক হলো, ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
গত শুক্রবার জেনেভায় ইরানি ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের আলোচনায় শুরুতে পরিস্থিতি কঠিন ছিল, তবে পরে ইতিবাচক দিকে মোড় নেয়। কিন্তু রোববার আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক পথ শেষ করে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন, ইরানিরা সব সময় বলে এসেছে, বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না। এখন সেই বন্দুক গুলিও চালিয়েছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আলোচনার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
আরএইচ