ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার (শেষপর্ব)

সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি মানুষ হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি মানুষ হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী অভিযান পরিচালনায় গত ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুমোদন দেয় দেশটির পার্লামেন্ট। একইদিন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার নেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমস।

এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার আইএসবিরোধী অভিযানের মূল্যায়নসহ তার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সন্ত্রাস দমনে সরকারের অবস্থান ও আইএসসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। গত ৬ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে সানডে টাইমস। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) প্রকাশ হলো। অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রাজিউল হাসান।

প্রশ্ন: জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ভিয়েনা আলোচনায় কোনো ফল আশা করছেন আপনি? এ আলোচনায় কি ধরনের চুক্তি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

বাশার আল-আসাদ: ভিয়েনা প্রজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটা হলো, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ আলোচনায় সকল সিরীয়কে একত্র হতে হবে। যদি আপনি মূল শর্তই সম্পন্ন করতে না পারেন, তাহলে বাকি শর্তগুলো কোনো কাজেই আসবে না। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান আমাদের সবাইকে এক হতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতা রয়েছেন, যারা সিরিয়ায় আসতে ভয় পায়। তাদের ধারণা, সিরিয়ায় অবতরণ করা মাত্র তাদের গ্রেফতার করা হবে।

বাশার আল-আসাদ: না, এমনটা কখনোই হয়নি। সিরিয়ায় একটি বিরোধী দল আছে এবং তারা যেকোনো কিছু করতে মুক্ত।

প্রশ্ন: না, আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছি বাইরের বিরোধীদের কথা। যেমন, হাইথাম মান্না। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন না।

বাশার আল-আসাদ: আমরা পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছি, যখন সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বপক্ষের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে, তখন যেকেউ আসতে পারে। আমরা গ্রেফতার করা হবে না বলে নিশ্চয়তাও দিয়েছি। আমরা এ কথা বহুবার বলেছি। এ বিষয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।

প্রশ্ন: সৌদি আরব সিরীয় বিরোধী নেতাদেরসহ ৬৫ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে বিদ্রোহী কমান্ডার যেমন আছেন, একইভাবে ব্যবসায়ী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। ভিয়েনা আলোচনাকে সামনে রেখে তাদের একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এখনও সিরীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিরোধী নেতাকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আপনি কি তাদের সঙ্গে  আলোচনা করার কোনো চেষ্টা করছেন?

বাশার আল-আসাদ: বেশ কয়েকটি বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। বাকিরা নিজেরাই আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারে না। কারণ তারা যেসব সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, তাদের কারণেই তারা পারে না। আমাদের দিক থেকে আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। আর যদি সৌদি আরবের প্রসঙ্গ ওঠে, তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা সরাসরি সন্ত্রাসীদের সহায়তা দিচ্ছে। তাদের আয়োজন করা ওই বৈঠক বাস্তবতায় কোনো ভূমিকাই রাখবে না।

প্রশ্ন: এখন সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে কি কখনো আপনি সিরিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন?

বাশার আল-আসাদ: আমরা এরই মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছি। শুরু থেকেই আমাদের অন্যতম নীতি ছিল সবগুলো পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসা। এমনকি যারা এখন লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছে,

তাদের সঙ্গেও। আমরা অনেক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। অনেকেই অস্ত্র ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব আলোচনায় ফলও পেয়েছি আমরা।

সিরিয়ার কিছু এলাকায় সংঘাত অনেকখানি কমে এসেছে। সংঘাতে থাকা অনেকে সিরিয়ান সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছে। কাজেই আমি আপনাকে বলতে পারি, আমরা আলোচনা করছি, তবে তাদের সঙ্গেই যারা সিরিয়ায় শান্তি চায়। তাই বলে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা আইএস বা আল- নুসরার সঙ্গেও আলোচনায় বসছি।

প্রশ্ন: বিদ্রোহীদের অভিযোগ, আপনার বাহিনী ব্যারেল বোমা ব্যবহার করছে। কিন্তু আপনারা তা প্রত্যাখ্যান করছেন। আপনি কি স্বীকার করেন, সিরীয় বাহিনী বেশ কিছু এলাকায় ব্যারেল বোমা ফেলাসহ নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়েছে, যার ফলে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে?

বাশার আল-আসাদ: ধরে নিলাম, এই অপপ্রচার সত্য, যদিও তা নয়। কিন্তু যুক্ততর্কের জন্যই আমি মেনে নিলাম এবং একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দিকে। তারা আফগানিস্তান ও ইরাকে কি করেছে? আমি শুধু ২০০৩ সালের পরে কথা বলছি না, আমি ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের কথাও বলছি। তাদের এসব লড়াইয়ে বিমান ও মিসাইল হামলায় কতো নিরপরাধ মানুষের প্রাণ গেছে? তারা সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি মানুষ হত্যা করেছে। কাজেই ইস্যুটা ব্যারেল বোমা ব্যবহার বা এই দুষ্ট প্রেসিডেন্ট প্রচুর ভালো মানুষ, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তাদের মারছে, তা নয়। এই রোমান্টিক চিত্র এখানে দাঁড় করালে চলবে না। মূল প্রশ্নটা হলো, কোন তথ্যের ভিত্তিতে কোথায় আপনি আপনার যুদ্ধোপরকরণ ব্যবহার করছেন। আপনারা যারা অভিযোগ করেন, তারা কি এটা বলতে চান, আমরা মানুষ মারার অভিযানে নেমেছি? এ ধরনের কাজ করার অর্থ একটাই, মানুষকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দেওয়া, যা আমাদের নীতির বিরোধী। আমরা কি

নিজেরা নিজেদের পায়ে গুলি করতে চাইবো? যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মোটেই বাস্তব ও যৌক্তিক নয়। এই অপপ্রচারে আর কোনো কাজ হবে না।

প্রশ্ন: মি. প্রেসিডেন্ট, সর্বশেষ প্রশ্ন। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনি সেনাবাহিনীসহ সবকিছুর নেতৃত্ব দেন। সিরিয়ায় যা ঘটেছে এবং ঘটছে, তার কোনো কিছুরই কি দায় আপনার ওপর বর্তায় না?

বাশার আল-আসাদ: পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকরা আমাকে বহুবার এ প্রশ্ন করেছেন। এ ধরনের প্রশ্নের লক্ষ্য, আমাকে কোণঠাসা করা। যদি আমি যা ঘটেছে ও ঘটছে, সেগুলোর দায়িত্ব স্বীকার করি, তাহলে তারা বলবে, দেখ, প্রেসিডেন্ট দায় স্বীকার করেছেন। যদি আমি দায় নিতে অস্বীকৃতি জানাই, তাহলে তারা বলবে, এটা সত্যি নয়। রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে আপনি কিভাবে দায় এড়াবেন?

প্রশ্ন: কারণ পরিবারের প্রধানের মতো আপনি দেশের প্রধান…

বাশার আল-আসাদ: আমাকে বলতে দিন। যেটুকু বলেছি, তা আমার জবাবের সূচনা ছিল। একদম শুরু থেকে আমরা আমাদের নীতি দু’টো স্তম্ভের ওপর ভর করে নির্ধারণ করেছি। প্রথমত, সবার সঙ্গে আলোচনা, এবং দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই। এখন আপনি যদি শুধু দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন, তাহলে আপনাকে সংঘাতের বহুদিক ও কারণ নিয়ে আলোচনা করতে হবে, যেগুলো আমাদেরকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। যা কিছু ঘটে গেছে তার দায় যদি আমাকে স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে কাতার যে সন্ত্রাসীদের অর্থ দিচ্ছে, তার দায়ও কি স্বীকার করতে হবে? কিংবা সৌদি আরব যে এ সংঘাতে অর্থ জোগান দিচ্ছে, তার দায় স্বীকার করতে হবে?

কিংবা পশ্চিমারা যে তাদের সন্ত্রাসীদের সিরিয়ায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে, তার দায় স্বীকার করতে হবে? সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর পশ্চিমারা যে রাজনৈতিক ছাতা মেলে ধরছে, যার ফলে বিশ্ব তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে নয়, মধ্যপন্থি হিসেবে চিনছে, তার দায়ও স্বীকার করে নিতে হবে? এভাবেই এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। খুব সাধারণভাবে বলে দিলেই হয় না যে, সে দায় স্বীকার করে নিয়েছে কিংবা নেয়নি। পরিস্থিতির প্রতিটা অংশ নিয়ে আমাদের আলোচনা করা দরকার। তারপরও যদি দায় নেওয়া নিয়ে আপনার মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যায়, তাহলে সিরিয়ায় সংঘাত শেষের পর তার উত্তর খোঁজাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ তখন আপনি পুরো গল্পের তদন্ত করতে পারবেন।

** সন্ত্রাস দমনের পরপরই সিরিয়া থেকে বহিঃশক্তি বিতাড়ন
** পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হলে এক মাসের মধ্যে সিরিয়ায় জঙ্গি নির্মূল
** পশ্চিমাদের কারণেই সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান

বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।