কী সেই কৌশল? এ নিয়ে ব্রিটেনের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও ডিজিটাল কৌশলবিদ অ্যান্ডি ড্যাঙ্গারফিল্ড লিখেছেন একটি নিবন্ধ। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই ‘জেনারেশন জেড’র। এই জেনারেশন বা প্রজন্ম বলতে বোঝানো হয় ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০০ দশকের শুরুর দিকে জন্ম নেওয়া মানুষদের। ইন্টারনেট আর অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার লাভের সময়ের এই প্রজন্মকে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে, তারা সংবাদপত্র পড়ে না। এমনকি পাঠককে আকৃষ্ট করতে সংবাদপত্রগুলোর আকার ছোট, প্রতিবেদন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত করা হলেও আকৃষ্ট হচ্ছে না প্রজন্ম।
এই ‘কথা’ যখন গণমাধ্যম অঙ্গনে ঘুরছে, তখন খবর মিলছে, যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো তাদের ‘ভবিষ্যৎ’ রক্ষায় ‘জেনারেশন জেড’ বা তাদের বছর কয়েক আগের প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে অভিনব সব পরিকল্পনা নিয়ে ‘বিনিয়োগ’ করছে।
সংবাদমাধ্যমে এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব থাকবে অনলাইনের হাতে। অনলাইনে যে সংবাদমাধ্যম যতো বেশি আধুনিক, সাবলীল, নজরকাড়া ও বিশ্বাসযোগ্য হবে, সেই সংবাদমাধ্যমই থাকবে নেতৃত্বের সারিতে। দৈনিকগুলোকে যদি পুরোপুরি অনলাইনে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামতে হয়, তাহলে পাঠক সংখ্যা বিচারে যেন তলানিতে পড়ে থাকতে না হয়, সেজন্য এই ‘বিনিয়োগ’ করছে তারা।
গবেষণা সংস্থা রয়টার্স ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন, রেডিও, সাময়িকীসহ ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ার ১৮-৩৪ বছর বয়সী পাঠক বেড়েছে বেশ। বিশেষত অনলাইনের অর্থব্যয়ী ‘জেনারেশন জেড’র হার বাড়ছে ক্রমে। ২০১৬ সালে যেখানে অনলাইনের অর্থব্যয়ী পাঠক বৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ, সেখানে গত বছর ২০১৭ সালে বেড়ে যায় ১৮ শতাংশ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপক ক্ষোভ ঝেড়ে ‘ফেক নিউজ’ স্লোগানে প্রচারণা চালালেও অনলাইনের অগ্রযাত্রা এতোটুকুন ব্যাহত হয়নি।
ছাপা পত্রিকার নানা প্রলোভনের মধ্যেও তাদের ত্রাহি অবস্থায় বিশ্লেষকদের বিস্মিত করছে অনলাইনের পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টি। রয়টার্স ইনস্টিটিউটসহ এ সংক্রান্ত প্রায় প্রত্যেকটি সমীক্ষাই বলছে, ব্রিটেনের দ্য টাইমস, দ্য টেলিগ্রাফ ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের মতো খ্যাতিমান দৈনিকগুলোর ছাপা সংস্করণ দুর্দশাগ্রস্ত হলেও তাদের অনলাইনের নিবন্ধিত পাঠক বা রেজিস্টার্ড পাঠক বাড়ছে। দ্য গার্ডিয়ানের মতো দৈনিকেরও নিবন্ধিত পাঠক বিগত ১২ মাসে বেড়ে ৫ লাখে পৌঁছে গেছে।
ছাপা পত্রিকার বাস্তবতা আর অনলাইনের এই অগ্রযাত্রা দেখেই দৈনিকগুলোকে তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় ‘বিনিয়োগের কৌশল’ নিতে হচ্ছে। কী তাদের কৌশল?
জাপানি মালিকানার ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আগে কেবল ব্রিটেনের ১৬-১৯ বছর বয়সী পাঠকরা বিনামূল্যে বা ফ্রি তাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রিপশন করতে পারলেও এখন এ সুবিধা গোটা বিশ্বের টিনেজদের জন্যই করে দেওয়া হয়েছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য এফটি’র বিনিয়োগ।
এ বিষয়ে এফটি’র বিজনেস টু বিজনেস ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাসপার ডে বোনো বলেন, কেবল ব্রিটেন থেকে ফ্রি ওয়েবসাইট ব্রাউজের যে প্রাথমিক কার্যক্রম ছিল, তার ফলাফল আমাদের অভিভূত করেছে। সেজন্য আমরা গোটা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে আমাদের ওয়েবসাইট ব্রাউজের সুযোগ করে দিয়েছি। এখন ১৫ শ’ স্কুলের ১৬ হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনামূল্যে সার্বক্ষণিক পড়ছেন ফিন্যান্সিয়ালটাইমস.কম।
আলোচিত বিষয় বা ট্রেন্ডিং টপিকস ধরলে বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়াদিই সুনির্দিষ্টভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এফটি’র এই কৌশলে।
বোঝাই যাচ্ছে যে এফটি সুদূরপ্রসারী ‘খেলা খেলছে’ এবং তারা আশা করছে, এই কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে পড়ার অভ্যাস গড়তে গড়তে যখন সংবাদমাধ্যমটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে বা পরবর্তী কর্মজীবনে পা রাখবে, তখনও এই সংবাদমাধ্যমটিরই সঙ্গে থাকবে।
কাসপার ডে বোনো বলেন, আমাদের উচ্চাভিলাসটা হলো, শিক্ষার্থীরা যদি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে মূল্যবান হিসেবে বুঝে নেয়, তাহলে তারা তাদের পরবর্তী জীবনে আমাদের অর্থ দিতে ঠকার শঙ্কায় ভুগবে না।
ডেইলি মিরর, সানডে মিরর, সানডে পিপল, সানডে মেইলসহ প্রায় আড়াইশ’ সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক কোম্পানি ট্রিনিটি মিররের মার্কেটিং ডিরেক্টর জোয়ে হ্যারিস এ বিষয়ে বলছেন, লোকজন আমাদের জিজ্ঞেস করে যে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী পাঠকদের বিবেচনায় নিলে আমরা কোন জায়গায় আছি। আমরা বলি বয়স্কদের চেয়ে তারুণ্যই আমাদের নিউজ ব্র্যান্ডকে এগিয়ে নিচ্ছে।
হ্যারিসের ভাষ্যে, তারুণ্যকে কাছে টানার জন্য আঞ্চলিক ব্র্যান্ডিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে ট্রিনিটি মিরর। কারণ, তারা মনে করে, কেউ যদি ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত হয়, তবে সে এই ক্লাবের ইতিবাচক খবর পাওয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকতার শরণাপন্ন হতে চাইবে এবং হয়তো সেই আশাবাদ থেকে আঞ্চলিক তথা ম্যানচেস্টারকেন্দ্রিক নিউজ সাইটেই বেশি ঢুকবে। এই বিষয়টি বিবেচনায় ট্রিনিটি মিররের অবস্থান সাদাকে সাদা বলা, লালকে লাল। তাছাড়া, এখন সংবাদমাধ্যম তথ্য জানার উপায় হলেও সোশ্যাল প্লাটফর্ম তা যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সবার কাছে, আবার ওই সংবাদমাধ্যমকেই তার পাঠকের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সোশ্যাল প্লাটফর্মে।
আরেক দৈনিক দ্য সান যুব পাঠকদের মনোযোগ টানতে চাইছে শোবিজ জগতের সংবাদ এবং মোবাইল ভিডিও আপ করার মাধ্যমে। তাদের ওয়েবসাইটের ৫১ শতাংশ পাঠক এখন নারী এবং ৪২ শতাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছর।
দ্য টাইমসও ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী পাঠকদের আকৃষ্ট করতে এমন নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যেটা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
সববয়সী পাঠক থাকলেও ১৮-২৪ বছর বয়সী পাঠকদের টানার এই প্রতিযোগিতায় উদ্যোগী দেখা যাচ্ছে দ্য টেলিগ্রাফকেও।
সবারই আশা, এই যুব পাঠকরা দীর্ঘমেয়াদে তাদের পাশে থাকবে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারসহ যুব পাঠকদের টানতে এতোসব উদ্যোগের মধ্যেও সম্প্রতি জার্মানির এলএমইউ মিউনিখের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন ও ছাপা সংস্করণ একইসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া পত্রিকাগুলোর পথচলা দ্বিধাগ্রস্তই বলা চলে। অনলাইনের কাছেই যেখানে মার খেয়ে তারা ভবিষ্যতের জন্য ‘বিনিয়োগ কৌশল’ নিয়েছে, সেখানে ছাপা সংস্করণের ‘মায়া’ ধরে রাখার কোনো মানে হয়?
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৮
এইচএ/