লক্ষ লক্ষ নয়, সব মিলিয়ে কোটি ছাত্রছাত্রী বন্দুক-ব্যবসা ও বন্দুক লবির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করবে। সরকারকে কঠোর বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন করতে বাধ্য করাই তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, দেশজুড়ে স্মরণকালর সর্ববৃহৎ এই প্রতিবাদ সমাবেশের উদ্যোক্তা কিশোর-তরুণ বয়সী ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রেরণা। যুক্তরাষ্ট্রের এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল পর্যন্ত সবখানে রাস্তাঘাট দখলে নেবে প্রতিবাদকারী এই কিশোর-তরুণরা। ওদের মূল সমাবেশটি হবে রাজধানী ওয়াশিংটনে। তাও আবার ক্যাপিটল হিলের খুব কাছে। যাকে বলে ঢিল ছোড়া দূরত্বে।
প্রতিবাদ সমাবেশটি নাম দিয়েছে তারা ‘‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভজ’’ (‘‘আমাদের জীবনের জন্য পদযাত্রা’’)। ফ্লোরিডার মারজোরি স্টোনম্যান ডগলাস হাইস্কুলে ১৪ ফেব্রুযারির মর্মান্তিক বন্দুক সহিংসতাই গোটা মার্কিন মুল্লুকের সব তরুণ-তরুণীকে বন্দুক লবি ও হীন বন্দুক ব্যবসার বিরুদ্ধে একাট্টা করেছে। ওই স্কুলেরই ১৯ বছর বয়সী সাবেক এক ছাত্রের গুলিতে মোট ১৭জনের মৃত্যু হয়।
ছাত্রছাত্রীরা চাইছে কঠোর আইন করে অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী মারাত্মক অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হোক। আইন প্রণেতাদের কাছে তাদের এই জোরালো দাবি। কিন্তু বন্দুক লবির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সিনেটর-কংগ্রেসম্যানরা নীরব হয়ে আছেন। চোখে ঠুলি পরে আছেন যেন তারা। যেন কিছুই দেখতে পারছেন না তারা। ঘুষের (ভদ্রভাষায় লবির টাকা) টাকা তাদের আন্ধা করে দিয়েছে। খিল মেরে দিয়েছে বিবেকের ঘরে।
তাই ছাত্রছাত্রীরা আইনপ্রণেতাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে, '‘হয় আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন, না থাকলে বুঝবো আছেন বন্দুকবাজদের পক্ষে’'।
যুক্তরাজ্যজুড়ে ৮০০টিরও বেশি বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও কিছু দেশে হচ্ছে সংহতি জানিয়ে। খোদ ওয়াশিংটনেই প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিতি ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
বন্দুকবাজি ও বন্দুক লবির বিরুদ্ধে ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত মায়েদের প্রতিবাদ সমাবেশ ‘‘মিলিয়ন মম মার্চ’’ -এর পর এতোবড় প্রতিবাদ সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রে আর হয়নি। অর্থাৎ মায়েদের পর আক্ষরিক অর্থেই এবার মাঠে নেমেছে তাদের '' সানস অ্কিযান্শোড ডটারস'' ---তাদের-তরুণ সন্তানেরা।
ছাত্রছাত্রীদের এই প্রতিবাদের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বন্দুক লবির লোকেরা নেই। তবে সমাজের বিবেকবান অংশটি ঠিকই আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা, মিশেল ওবামা, অপরাহ উইনফ্রেসহ বহু বিখ্যাত মানুষ সংহতি জানিয়েছেন ‘‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভজ’’ প্রতিবাদ সমাবেশের প্রতি।
ওবামা ও মিশেল ওবামা ‘পার্কল্যাণ্ড স্টুডেন্ট’দের প্রশংসা করে একটি খোলা চিঠিও লিখেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, এই ছাত্রছাত্রীরা জাতির টনক নড়িয়ে দিয়েছে। ওদের ঐক্যবদ্ধ মানসিকতা, সংকল্প ও সহনক্ষমতা গোটা জাতির জন্য প্রেরণা।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে নিজে উদ্যোগী হয়েও বন্দুক লবির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি ওবামা। কারণ আইন প্রণেতাদের বড় একটা অংশ বন্দুক লবির ‘পোষা লোক’। ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) যেন ওদের বিবেক আর আত্মা দুটোই কিনে নিয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিটন বলেছেন, স্টোনম্যান ডগলাস হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে গোটা জাতি কৃতজ্ঞ।
কানেকটিকাটের সিনেটর মার্ফি বলেছেন, এই ছাত্রছাত্রীরা ভোটার হয়ে ওঠার পর হয়ে উঠবে বিশাল এক ইলেকটোরাল ফোর্স। তখন ওদের কথা না শুনে কারোরই উপায় থাকবে না।
এভাবেই বিন্দু বিন্দু করে একতার এক বিশাল সিন্ধু রচিত হতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রে। যার প্রবল স্রোতের তোড় ক্ষমতা কাঠামোতে ধাক্কার পর ধাক্কা দেবে। দেবেই দেবে।
কেননা এক পরিসংখ্যান বলছে, মার্কিন ভোটারদের ৬৩ শতাংশই বন্দুবিরোধী ‘‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভজ’’-সমাবেশের সমর্থক। এমনটা অকল্পনীয় ছিল কিন্তু সেটাই হচ্ছে। তারুণ্যের শক্তি একেই বলে।
রবীন্দ্রনাথের বাণীটাই যেন সত্য হবে এবার:
‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা
আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। ’
লোভী বুড়োর দল বা বয়স্করা যা পারেনি বা করেনি, এবার সেটাই করে দেখাবার জন্য মাঠে নেমেছে কচি কাঁচার দল। ‘আধ মরা’ ঘুনেধরা সমাজকে ঘা মেরে বাঁচাতে। ওদের ‘টাবুলা রাশা’র (‘অলিখিত শাদা কাগজ’) মতো মনে অর্থ-লালসার নোংরা দাগ পড়েনি। ওরা বন্দুকবাজ নামের কোনো মেফিস্টো বা শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করেনি। সেজন্যই কোটি মানুষ ভরসা রাখছে ওদের ওপর।
আশা করা যায়, বন্দুকবাজ লবির দৌরাত্ম্য কমাতে এবং টেকসই কিছু একটা করতে প্রশাসন বাধ্য হবে এবার। কারণ প্রতিবাদ এখানেই শেষ নয়, প্রতিবাদের এটা কেবল শুরু। মাইলস টু গো ...
বাংলাদেশ সময়: ১৫১২ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৮
জেএম