ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ভারতের ক্ষমতাসীনরা কেন লেগেছে নোবেলজয়ী অভিজিতের বিরুদ্ধে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৯
ভারতের ক্ষমতাসীনরা কেন লেগেছে নোবেলজয়ী অভিজিতের বিরুদ্ধে?

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্ববাসীকে নতুন পথের দিশা দেখিয়ে নোবেল জয় করেছেন তিনি। সেজন্য গোটা বিশ্ব এখন তার বন্দনায়। ভারতের বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের এই কীর্তিতে গোটা দেশজুড়েও দেখা যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। কেবল ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারাই তোপ দেগে চলেছেন অভিজিৎকে। কেন এই নোবেলজয়ীর বিরুদ্ধে লেগেছেন তারা? এ নিয়েই এখন আলোচনা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে।

গত সোমবার (১৪ অক্টোবর) রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী হিসেবে অভিজিৎসহ তিনজনের নাম ঘোষণা করে। বাকি দু’জন হলেন অভিজিতের স্ত্রী ফরাসি নাগরিক এস্থার দুফলো এবং মার্কিন নাগরিক মাইকেল ক্রেমার।

চতুর্থ বাঙালি হিসেবে নোবেল পাওয়া অভিজিতের জন্ম মুম্বাইয়ে হলেও তিনি প্রথমে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক ও পরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি শেষ করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) অধ্যাপনা করছেন তিনি। তার স্ত্রীও অধ্যাপনা করছেন এমআইটিতে।

ত্রিরত্নকে নোবেল ‍পুরস্কারে ভূষিত করার বিষয়ে সুইডিশ একাডেমির তরফ থেকে বলা হয়, ‘তাদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়ার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে তাদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম অনুসরণীয় মডেল। ’

গবেষণাটা আসলে কী? এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, ‘র‌্যান্ডামাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ নামে চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটা কথা আছে। এই তত্ত্বে একইরকম আর্থ–‌সামাজিক পরিবেশে একদল শিশু-কিশোরকে বিশেষ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য, আর একদলকে দেওয়া হয় না। দু’টোর ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়ে তা নিরূপণ করাই ‘র‌্যান্ডামাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’র কাজ। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ও তার সহযোগীরা এই ‘র‌্যান্ডামাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’টাই ফলিত অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।

তাদের গবেষণা অনুসারে, কেবল অর্থ দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা কঠিন। দারিদ্র্য কখনই একমুখী নয়, তা বহুমুখী। এটা বিশ্বের সব দেশের সব জায়গায়ই বাস্তব সত্য। তাই, দারিদ্র্যমুক্তি ঘটাতে গেলে দরিদ্র মানুষের উন্নতি ঘটাতে গেলে, শুধু তার আর্থিক দুর্বলতার দিকটা বিবেচনা করলেই হয় না। বিবেচনা করতে হয় তার মানসিক দারিদ্র্য, সামাজিক দারিদ্র্য ও অবস্থানগত দারিদ্র্য।

এই গবেষণার জন্য ২০০৩ সালে এমআইটিতে ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ বা ‘জেপ্যাল’ গঠন করেন অভিজিৎ ও তার সহযোগীরা। জেপ্যালের কাজ উন্নতশীল দেশগুলোতে মানবজীবনের মানোন্নয়ন নিয়ে গবেষণা। এছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আর্থিক নীতিগঠনে সহায়তা প্রদান, আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলা ও ক্ষমতায়নের নানা কর্মসূচিও রয়েছে এর কার্যতালিকায়।

‘জেপ্যাল’র কর্মপরিসর প্রসঙ্গে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডেভিড রোমার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমান অর্থনীতির কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দারিদ্র্যের। কেন বিশ্বের এত এত মানুষ দরিদ্র? আর অর্থনীতির এখানে আসলেই কী করণীয়? জেপ্যালের কাজের সাহায্যে এখন আমরা আস্তে আস্তে এই প্রশ্নগুলোর ধারণা পাচ্ছি।

সংবাদমাধ্যম বলছে, উন্নয়নশীল-বিশ্বে দারিদ্র্য ঠেকাতে চালু রয়েছে একাধিক সহায়তা প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু সফল হচ্ছে এই প্রকল্পগুলো, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও প্রতিবেদন দিচ্ছে জেপ্যাল।  

গোটা বিশ্ব অভিজিৎ ও তার সহযোগীদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের গবেষণার প্রশংসা করে এলেও ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাদের মুখে শোনা যাচ্ছে খেদোক্তি।  

অভিজিৎকে ‘অভিনন্দন’ জানালেও বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেন, ‘নোবেল পাওয়ার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন, তিনি বামপন্থি মানসিকতার। ’ তার এ বক্তব্যের পর বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেন, ‘বামপন্থি অর্থনীতি এদেশে চলে না। মানুষ বামপন্থি অর্থনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিদেশে কোথাও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্ব কাজে লাগতে পারে। ভারতে দারিদ্র্য দূর করতে তিনি কোনো কাজে আসবেন না। ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নীতিতেই আর্থিক উন্নতি সম্ভব। ’

প্রশ্ন হচ্ছে, বিজেপির নেতারা কেন প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন এ নোবেলজয়ীকে? জানা যায়, গত ১৬ বছর ধরে গবেষণা থেকে যে যুগান্তকারী চিন্তাধারা উদ্ভাবন করেছেন, তা ‘হোয়াট দ্য কান্ট্রি নিডস নাও’ শীর্ষক বইয়ে তুলে ধরেন অভিজিৎ ও এসথার। সেখানে ভারতের বর্তমান আর্থিক অবস্থা ও মন্দা থেকে উত্তরণের পরামর্শ উল্লেখ করা হয়। অভিজিতের এ চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আসছিলেন বিজেপি নেতারা।  

বিরোধিতার বড় জায়গা তৈরি হয় আরও আগে। বর্তমান বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিরোধী অভিজিৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘নোটবন্দি’ বা ডিমনিটাইজেশনের কড়া সমালোচনা করলে তখন থেকেই তাকে আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। তাছাড়া গত এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অর্থনীতিবিদ অভিজিৎকে একপ্রকার ‘রাজনৈতিক বিরোধী’ বানিয়ে ফেলে বিজেপি। তখন অভিজিতের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে ‘ন্যায়’ প্রকল্প উত্থাপন করে। যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষকে মাসে ছয় হাজার রুপি দেওয়ার আশ্বাস দেন কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী। ওই প্রকল্পটির বিরোধিতা করে বিজেপি। দেশের রাজকোষে টান পড়বে বলে পাল্টা প্রচার করে তারা। যদিও নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হওয়ায় প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ওই প্রকল্পটি দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে সফল হতে পারতো বলে মত দিয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এদিকে বিজেপি নেতারা অভিজিৎকে এভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালেও তার পাশে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ-শিক্ষাবিদরা। এমনকি রাজনীতিকদেরও পাশে পাচ্ছেন অভিজিৎ। নোবেল জয়ের পর অভিজিৎকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাহুল গান্ধী তার টুইটারে লেখেন, ‘ভারতের আর্থিক উন্নয়নে ও দারিদ্র্য দূর করতে ন্যায় প্রকল্পের রূপরেখা তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন অভিজিৎ। তার বদলে এখন চলছে মোদীনীতি। যা দেশের অর্থনীতিতে ধ্বংস করছে। বাড়ছে দারিদ্র্য। ’ 

পীযূষ গোয়েল ও রাহুল সিনহাদের মন্তব্যের সমালোচনায় সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। দেশজুড়ে যারা জাতিবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তারা নোবেলজয়ী কীর্তিমান সম্পর্কে এরকম কুরুচিকর মন্তব্য করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।