ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

কে এই বংবং মার্কোস?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২২
কে এই বংবং মার্কোস? ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র ওরফে বংবং। ছবি:রয়টার্স

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র (৬৪)। মার্কোস জুনিয়র তার বংবং নামেই বেশি পরিচিত।

তিনি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছেন। শোনা যাচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে গেছেন তিনি।

বংবং মার্কোস হচ্ছেন- ফিলিপাইনের সাবেক স্বৈরশাসক ফের্দিনান্দ মার্কোস ও সাবেক ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের ছেলে।

স্বৈরশাসকের ছেলে হয়েও তিনি কীভাবে নির্বাচনে জিতলেন? এর উত্তর নিহিত আছে বংশানুক্রমিক রাজনীতির চক্রান্তের জাল, কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা আনুগত্য আর সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চতুর কৌশলের মধ্যে।

ফিলিপাইনের ইলোকোস নর্তে অঞ্চলটি মার্কোস পরিবারের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে স্প্যানিশ কায়দায় তৈরি এক রাজকীয় প্রাসাদ, যেটিকে বলা হয় উত্তরের মালাচিয়াং প্রাসাদ। মূল মালাচিয়াং প্রাসাদ আসলে হাজার মাইল দূরে রাজধানী ম্যানিলায়, এটি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন।  

বংবং মার্কোসের বাবা ফার্দিনান্দ মার্কোস যখন ফিলিপাইন শাসন করছেন, তখন ১৯৬০ এর দশকে ইলোকোস নর্তের এ প্রাসাদটি তার পরিবারকে উপহার দেয় দেশটির পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ফার্দিনান্দ মার্কোস। গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী কর্মীরা যখন ম্যানিলায় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে পড়েছিল, তখন সেখানে মার্কোস পরিবারের বহু চমৎকার তৈলচিত্র, সোনায় মোড়ানো জাকুজি, ১৫টি মিংক কোট দেখতে পান। ফার্স্ট লেডি ইমেলদার সাজঘরে গিয়ে দেখা গেল- শত শত ডিজাইনার গাউন। পোশাকগুলো নিউ ইয়র্ক, প্যারিস বা রোমের নামকরা সব ফ্যাশন ব্রান্ডের। অনেক পোশাক লেবেল যুক্ত ছিল। অথ্যাৎ সেগুলো একবারও পরা হয়নি। তার ঘরে মোট ৫০৮টি ডিজাইনার গাউন এবং তিন হাজার জোড়া জুতার সংগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।


ইমেলদা মার্কোসের সেই বিতর্কিত জুতার সংগ্রহ

এ পরিবার বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি অর্জন করে তাদের দুর্নীতির জন্য। বংবংয়ের বাবার শাসনামলে ফিলিপিনে কী ব্যাপক দুর্নীতি আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল, আদালতের রেকর্ড আর সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত বিবরণ এবং প্রমাণ আছে।

কিন্তু সেই পরিবারেরই সন্তান বংবং এরই মধ্যে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফলে ভূমিধস জয় পেয়েছেন। তার নির্বাচনী প্রচারণা যখন চলছিল বিপুল উদ্যমে, তখন সমর্থকরা অতীতের এসব ঘটনা এবং তথ্য সম্পর্কে তাদের সংশয় প্রকাশ করছিলেন। বংবংয়ের বিরোধী শিবিরের লোকজন এজন্য দায়ী করছেন সোশ্যাল মিডিয়াকে। তাদের মতে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, মার্কোস পরিবারের কলঙ্কময় অতীত মুছে ফেলা হয়েছে। তবে মার্কোস পরিবার এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

বহু বছর ধরেই ফেসবুকে ভুয়া একাউন্ট আর নানা রকমের প্রোপাগান্ডা পোস্ট দিয়ে চালানো হচ্ছে মার্কোস পরিবারের গুণকীর্তন। এসব পোস্টে অতীত ইতিহাসকে এতটাই বিকৃত করা হয়েছে যে, লোকে এসব ভুল তথ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তোতাপাখির মতো সেগুলোকেই সত্য বলে পুনরাবৃত্তি করে।

ভুয়া একাউন্টের এসব পোস্টে সাধারণভাবে একটা কথাই বেশি করে বলা হয়- মার্কোসের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলটাই ছিল ফিলিপাইনের 'স্বর্ণযুগ'। সত্যিকার অর্থে তখন ফিলিপাইনের অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন দেশটি ছিল বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত।

মার্কোস পরিবার কীভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বেআইনিভাবে সুইস ব্যাংকে পাচার করেছে, কীভাবে নিউ ইয়র্কের অভিজাত এলাকা ম্যানহাটানে কয়েকটি বাড়ি কিনেছে, তার দলিলও পাওয়া গিয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়। কিছু মামলায় পরিবারের সদস্যদের দণ্ড হয়, অন্য কিছু মামলায় তারা খালাস পান। এরমধ্যে ১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্কে প্রতারণার আলোচিত একটি মামলায় মিসেস মার্কোস জুরিদের বিচারে খালাস পান এবং তিনি আবার ফিলিপিনে ফিরে আসেন।


দেয়ালে শোভা পাওয়া ছবিটিতে বংবং এর এক হাতে ফিলিপিনের পতাকা

নেতা হওয়ার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে বংবংয়ের, সেভাবেই ছোটবেলা থেকে তাকে বড় করা হয়। গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৮৬ সালে যেদিন মার্কোস পরিবারকে প্রাসাদ ছাড়তে হয়, সেদিনের কিছু ফুটেজে দেখা যায়, ২৮ বছর বয়সী বংবং সামরিক পোশাকে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

তবে ১৯৭২ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোসের এক ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ উৎকণ্ঠার ভুগতেন। এতে তিনি লিখেছেন, বংবংকে নিয়েই আমাদের বেশি চিন্তা। ও খুব বেশি বেপরোয়া আর অলস।

বংবং ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফিলজফি, পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনোমিক্স (পিপিই) পড়ার জন্য, যেটিকে রাজনীতিতে কেরিয়ার গড়ার জন্য আদর্শ একটি কোর্স বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেন নি। অবশ্য বংবং তা অস্বীকার করেন।

পিলিপাইনের মানুষ এখন বিশ্বাসই করতে চায় না যে মার্কোস পরিবার দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দোষী। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে তাদের এ বিশ্বাস আরও দৃঢ় করা হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও বংবংয়ের শিবির বিরাট বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ জনসভার আয়োজন করে। তবে সেখানে বংবং মার্কোসকে ঘিরে রাখেন লাল শার্ট পরা শত শত সমর্থক, যাতে সাংবাদিকরা তার ধারে কাছে ঘেঁষতে না পারেন, তাকে কোনো প্রশ্ন করতে না পারেন। যারা এসব জনসভায় যোগ দেন, তাদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় রিস্টব্যান্ড, টি শার্ট বা কফির প্যাকেট। এসবের গায়ে বংবং মার্কোসের হাস্যোজ্জ্বল ছবি সাঁটা।

জনতাকে সেখানে পপ মিউজিক, কমেডি আর নাচ দিয়ে উজ্জীবিত করা হয়। এরপর মার্কোস সমর্থক রাজনীতিকরা এসে একের পর এক বক্তৃতা দেন। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের নীতি কী হবে, সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা অবশ্য খুব কমই দেখা যায়।

মার্কোস পরিবারের সমালোচকরা বলছেন, বংবং যেভাবে তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেই তার অসততার পরিচয় মেলে। তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হতে চান না, তিনি সারাক্ষণ তার বশংবদ লোকজন, যারা সারাক্ষণ তার কথা হ্যাঁ বলবে, তাদের দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখেন।

৩৬ বছর পর আবারও একই পরিবারের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসায় তারা আশংকা করছেন, বংবং মার্কোস ফিলিপাইনকে সেখানেই নিয়ে যাবেন, ১৯৮৬ সালে তার বাবা দেশটিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২২
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।