ঢাকা, বুধবার, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

মুঘল ইতিহাসের সাক্ষী আরিফাইল মসজিদ ও ‘রহস্যময় জোড়া কবর’

মেহেদী নূর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
মুঘল ইতিহাসের সাক্ষী আরিফাইল মসজিদ ও ‘রহস্যময় জোড়া কবর’ সাড়ে ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো ঐতিহাসিক আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ইসলাম ধর্মের অনন্য নিদর্শন ও মুঘল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটি দেখতে অনেকটা তাজমহলের মতো।

 

স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, ১৬৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরিফাইল গ্রামে মসজিদটি নির্মিত হয়। দরবেশ শাহ আরিফ এই মসজিদ নির্মাণ করেন।  তার নামানুসারেই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়।

আরও জনশ্রুতি রয়েছে, মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি দিঘী, যার পানি পান করলে মিলতো রোগমুক্তি।  

এছাড়াও মসজিদটির দক্ষিণে রয়েছে দুটি কবর, যা ‘জোড়া কবর’ বা ‘রহস্যময় কবর’ নামে পরিচিত। কবর দুটিতেও মুঘল স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর প্রভাব বিদ্যমান।  

এ বিষয়ে অনেক জনশ্রুতি ও কল্পকাহিনী প্রচলিত। তবে এগুলো কার বা কাদের মাজার, কে শুয়ে আছেন এই কবরে তার প্রকৃত তথ্য কারও জানা নেই।   জনশ্রুতিকেই বিশ্বাস করে প্রতিদিন লোকজন এসে নামাজ আদায়ের পর এই মাজারে বিভিন্ন মান্নত করেন।  

আরিফাইল মসজিদে রহস্যময় জোড়া কবর

এই নান্দনিক শৈলীর ভেতরে সংরক্ষিত রহস্যময় জোড়া কবর

আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ আয়তনে লম্বায় ৮০ ফুট ও প্রস্থে ৩০ ফুট। মসজিদের চার কোনায় চারটি বুরুজ ও মোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোর নিচে মসজিদের ভেতরে অংশকে তিন ভাগে ভাগ করেছে। গম্বুজগুলোতে পদ্মফুল অঙ্কিত রয়েছে।  

সরাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের আড়িফাইল গ্রামে গিয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদটি এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মূল ফটক থেকে শুরু করে মসজিদের ভেতরেও বিভিন্ন অংশ কারুকার্য যেন জানান দিচ্ছে মুঘল আমলের উৎকর্ষতার।  

চুন, সুরকি আর ইটের গাঁথুনির সঙ্গে মসজিদের ভেতরে ও বাইরের অপরূপ কারুকার্যগুলো সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মসজিদটির উত্তর পাশেই বিশাল আয়তনের সেই দীঘি। যার একটির নাম সাগর দীঘি।  

স্থানীয় বাসিন্দা শের আলম বাংলানিউজকে বলেন, শত শত বছর যাবত আরিফাইল মসজিদ টিকে আছে ইতিহাসের নির্দশন হিসেবে। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি আশপাশে কোন মসজিদ ছিল না। সে সময় এখানে এসে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন নামাজ আদায় করতেন। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসে। তবে এখানে আসার সড়ক যোগযোগ ব্যবস্থা সরু হওয়ায় দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ রাস্তাটি প্রশস্ত করলে চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

মসজিদের ভেতরের নান্দনিক কারুকার্য

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা মো. সুমন ঠাকুর বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে মসজিদটি এর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসেন এটি দেখতে। এখানে নামাজ পড়তে অনেক লোকজন আসেন। কিন্তু জায়গার অভাবে অনেক কষ্ট হয়। মসজিদ উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা হলে আরও ভালো হবে।

প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল লতিফ খন্দকার বাংলানিউজকে বলেন, এটি ঈশা খাঁ আমলের নির্মিত হয়েছে বলে আমরা বাব-দাদা কাছ থেকে শুনেছি। অনেকেই আবার গায়েবি মসজিদ বলেও ডাকে একে। এর উত্তর পাশে একটি বড় দিঘী রয়েছে। এটি সাগর দিঘী পরিচিত। এর পানি পান করলে বিভিন্ন রোগ মুক্তি থেকে ভালো হয় বলে বিশ্বাস। এটাকে যদি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

মসজিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা বাবুল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, মসজিদের ভেতরের কারুকাজ খুবই নান্দনিক। পুরাতন হলেও দূর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকলেও তারা কোনো দেখভাল করেন না। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে।

আরাফাইল মসজিদের খতিব নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদে আজান দিচ্ছি ও ইমামমতির দায়িত্বে আছি। প্রতিদিনই এটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটক আসেন এখানে। টাকা-পয়সাও দান করেন তারা। এলাকাবাসী ও পর্যটকদের টাকায় এই মসজিদ চলে।

আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন মন্তু বাংলানিউজকে বলেন, আগ্রার তাজমহলের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে এই মসজিদের। আগ্রার তাজমহল পাথরে গড়া। এটি ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীন হলেও তারা কেবল সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর উন্নয়নে তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর রক্ষণাবেক্ষণে আমরা স্থানীয় লোকজন দেখভাল করে আসছি।  

সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, সরাইল একটি ঐতিহ্যবাহি জনপদ। পূর্বে পরগণার রাজধানী ছিল। প্রায় কয়েকশ বছরের পুরানো আরিফাইল মসজিদ। এটি দেখার জন্য অনেক পর্যটক আসে। এটির অন্যন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যাতে করা যায় সে উদ্যোগটি নেওয়া হবে। সড়কটি যেহেতু সংকীর্ণ, কীভাবে প্রশস্ত করা যায় সে বিষয় আমরা দেখব।

যেভাবে যাওয়া যায়

বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল বিশ্বরোড মোড় নেমে সিএনজি অটোরিকশা যোগে ২০ মিনিট গেলেই সরাসরি মসজিদে যাওয়া যায়। সরাইল উপজেলা চত্বরের মূল ফটক থেকে রিকশা যোগে কিংবা পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।