দীর্ঘ এক বছরের স্বপ্ন ও সাধনা একটি সফল কোরবানির একজন মুমিনের, এমনকি একজন বিক্রেতার স্বপ্ন একটি সার্থক কোরবানি। কোরবানির পশু বিক্রেতার ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও হালাল উপার্জন দিয়ে পশু কেনা ইবাদতের মৌলিক শর্ত।
যারা ধনী, তারা মাংস গরিব আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলাবেন, এটাই বিধান। পলিথিনভর্তি মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ করে একা খাওয়া অনুচিত। কোরবানির সামর্থ্য না থাকলে বাধ্যবাধকতা নেই, তবুও ঋণ করে কিংবা অসৎ পথে উপার্জন করে কোরবানি করা যাবে না। ইসলাম আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, এর আধ্যাত্মিক আবেদন আনুষ্ঠানিকতার বহু ঊর্ধ্বে। কোরবানির পশু লালনপালন, পরিবহন, যানবাহনে ওঠানো নামানো ও জবাইয়ের আগ পর্যন্ত পর্যাপ্ত যত্ন নেওয়া ও খাবার দেওয়াও ধর্মীয় অনুশাসন। কোরবানির পশুকে ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত রাখা পাপ। কোরবানিকে আনন্দ-উৎসবে পরিণত করা অনুচিত। তাজা মাংস ভোজনের উৎসব, বড় গরু কেনার উৎসব উপার্জিত ও ধনীদের মধ্যে মাংস বিতরণের উৎসব কোরবানির উদ্দেশ্য ম্লান করে দেয়। কোরবানির অর্থ হালাল কি না, মাংস বিতরণ ন্যায্য হয়েছে কি না—এসবই আল্লাহর বিচার্য।
কোরবানির পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলাও ধর্মীয় অনৈতিকতা। আমাদের আচরণ যখন অন্যের কষ্ট বা দুর্ভোগের কারণ হয়, তখই তা বান্দার হক বিনস্ট হবার অপরাধ। কোরবানিদাতার নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীর কাছে যদি মাংস না পৌঁছে, যারা এর প্রকৃত হকদার, যারা কোরবানি দিতে অক্ষম, তবে কোরবানির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে আল্লাহর কাছে।
ঋণগ্রস্ত, অভাবগ্রস্ত, জাকাতপ্রাপ্ত হয়েও শুধু সন্তানের আবদার রক্ষা কিংবা সামাজিক মর্যাদা রক্ষার যুক্তিতে কোরবানি করা ইসলাম সমর্থন করে না। কোরবানি শুধু আল্লাহর জন্য, মানুষের সন্তুষ্টি বা প্রশংসার জন্য নয়। মানুষের প্রশংসা বা সমালোচনা অন্তরে স্থান দিয়ে যে কোরবানি, মহান আল্লাহর সঙ্গে তা শিরকের সমতুল্য পাপ। কারণ এ ক্ষেত্রে বান্দাকে আল্লাহর সমকক্ষতায় স্থান দেওয়া হয়। এ ধরনের কোরবানি জাহান্নামপ্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করবে। শ্রমজীবী, কর্মজীবী বা অধীনস্থদের প্রাপ্য বেতন, ভাতা বা বোনাস থেকে বঞ্চিত করে, সরকারি কর পরিশোধ না করে কিংবা শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে অথবা সরকারি রাজস্ব বা বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দিয়ে কোনো ব্যবসায় বা শিল্পপতি যা অনৈতিক মুনাফার পাল্লা ভারি করেন, তবে ওই অর্থ দিয়ে বিশাল গরু কিনে কোরবানি দেওয়াতে সওয়াব হবে না। বান্দার হক নষ্ট করে, রাষ্ট্রের পাওনা পরিশোধ না করে কোরবানির কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ বান্দার হক তথা মানুষের অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।
জাকাতদাতা হয়ে জাকাত পুরোপুরি আদায় না করে, জাকাতকে আয়করের মত ফাঁকি দিয়ে আংশিক জাকাত অনাদায়ি রেখে বিশাল গরু কিনে কোরবানি করেন, সে কোরবানিও আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। নামাজ, জাকাত ইত্যাদি ফরজ ইবাদত পুরোপুরি আদায় করে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, অভাবগ্রস্ত, অধীনস্থদের হক আদায় করে ও ঋণমুক্ত ও দায়মুক্ত থেকে নিজের শতভাগ হালাল উপার্জিত অর্থ দিয়ে শুধু আল্লাহর হুকুম পালনের চেতনা অন্তরে ধারণ করে যে কোরবানি, তাই নিঁখুত ও শ্রেষ্ঠ কোরবানি। এ কোরবানি পরকালের নাজাতের উছিলা ও পাথেয়। পার্থিব জীবনে আমরা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা পেশাগত বা ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য প্রচুর শ্রম, অর্থ, সময় ত্যাগ করি। কিন্তু আল্লাহর পথে ব্যয়, স্বার্থ ত্যাগ বা কোরবানি অনেক উচ্চমার্গের আমল। নিজের ধনসম্পদ, মেধা, শ্রম ও সময় যদি আল্লাহর পথে কোরবানি করি, তবে সমাজে ন্যায়বিচার, সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সামাজিক বৈষম্য দূর হবে। এটিই ইবাদতের মূল তত্ত্ব।
সমাজে আজ যত শোষণ, পীড়ন ও বৈষম্য, তা একমাত্র সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করার ফসল। কোরবানির গরু কেনার পেছনে বাংলাদেশে প্রায় ১০/১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, যার সুফলভোগী সাধারণ দরিদ্র মানুষ। কেউ মাংস পেয়ে, কেউ মজুরি পেয়ে, কেউ চামড়া বিক্রির অর্থ পেয়ে নিজ নিজ অভাব মোচন করছেন। পুষ্টির অভাবে যারা জীর্ণশীর্ণ, তারা কোরবানির সুবাদে মাংস খাওয়ার অধিকার পাচ্ছেন। এটা দরিদ্রের হক। এভাবে বিত্তবানরা কোরবানির শিক্ষা থেকে যদি সারা বছর দান, অনুদান কিংবা পশু কিনে মাংস বিতরণ করেন, তবে তা দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূরীকরণে বিশাল ভূমিকা রাখবে।
কোরবানির মাংস দীর্ঘদিন জমা রাখতে ফ্রিজের কদর অতুলনীয়। টনে টনে মাংস ধনীদের ফ্রিজে মাসের পর মাস জমা থাকে। ইসলাম তা সমর্থন দেয় না। যত বেশি পরিমাণে সম্ভব কোরবানির মাংস দরিদ্রদের দান করা উত্তম। অধিক মাংস খাওয়ার লোভ বিসর্জন দিয়ে অকাতরে দরিদ্রদের মাংস দান করা প্রকৃত কোরবানি। লোভমুক্ত থাকা, লোভ সংবরণ করা, লোভ বিসর্জন দেওয়াই কোরবানির প্রকৃত সার্থকতা।
কোরবানি উপভোগের কোনো উৎসব নয়, ত্যাগের ইবাদত। আমাদের ভোগবাদী জীবনে আমরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করি বিলাসে, বিনোদনে, নানা অনুষ্ঠানে। অনেক অনৈতিক কাজেও আমরা বেপরোয়া অর্থ ব্যয় করি। অথচ এসব অনুষ্ঠানে বা বিনোদনে দরিদ্রদের অংশ নেই, হিস্যা নেই। কিন্তু কোরবানি এমন একটি মহৎ ও মানবিক ইবাদত, যেখানে ধনীরা যে মানের মাংস বা খাবার গ্রহণ করেন, দরিদ্ররাও সমমানের খাবারে শরিক হন। ইসলামের শাশ্বত বিধান হলো, ধনী ও দরিদ্রে বৈষম্য ও বিভাজন দূর করা। কোরবানি হলো আত্মিক ইবাদতের সমান্তরালে সামাজিক ও আর্থিক ইবাদত।
যে কাজে অনৈতিক উপার্জন, আড়ম্বরপূর্ণ ব্যয় বা প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা থাকে, তা আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্য। যে ইবাদতে বিশুদ্ধ নিয়ত বা অভিপ্রায় থাকে মহাপ্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাই আল্লাহ পরম যত্নে গ্রহণ করেন এবং তাই হবে পরকালীন মুক্তির মাধ্যম। কোরবানির পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা দুর্নীতি, অন্যায়, অমানবিকতা ও পাপাচারের মানসিকতা বিসর্জন দিয়ে অন্তরে সততা ও নৈতিকতাকে গ্রহণ করি, তবে তা হবে কোরবানির পরম প্রাপ্তি ও সাফল্য। কোরবানি কবুলের নিয়ামক হলো মন থেকে আমিত্ব, অনৈতিকতা ও অন্যায় বিসর্জন দেওয়া এবং সৎ ও শুদ্ধ জীবনের পথে চলা।
লেখক: মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর
Email: [email protected]