কবর জিয়ারতের নিয়মরংপুরে হজরত কেরামত আলী জৌনপুরী (রহ.)-এর মাজার। যেখানে লিখে রাখা হয়েছে কবর চুমু দেওয়া, মাথা নোয়ানো ইত্যাদি নিষেধ।
অনেকেই মনে করেন, অলি-আউলিয়া কিংবা পীর-বুজুর্গদের সমাধিকে মাজার বলতে হবে; কবর বলা যাবে না। এতে নাকি তাদের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়। এমন ধারণা অমূলক।
অনেক সময় দেখা যায়, অনেকেই বিভিন্ন অলি-আউলিয়াদের কবর কিংবা মাজারকে সিজদা করেন, চুমু দেন, কবরকে ভক্তি দেখিয়ে পেছন হয়ে বের হন, মাজারে গিলাফ চড়ান, মাজারে টাকা-পয়সা মান্নত করেন, মাজারে কিংবা আশেপাশে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালান, গোলাপ জল ছিটান। এসব কাজের কোনোটাই শরীয়তসম্মত নয়।
কবর শব্দের অর্থ দাফনস্থল অর্থাৎ যে স্থানে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়। আর মাজার শব্দের অর্থ হলো- জিয়ারত করা কিংবা জিয়ারতের স্থান। তাই যে কোনো মুসলমানের দাফনের স্থানকে যেমন কবর বলা যায় তেমনি যে কোনো মুসলমানের কবরকে আভিধানিক অর্থে মাজারও বলা যায়।
কেননা, সব মুসলমানের কবর জিয়ারত করা বৈধ। বুজুর্গ, নেককার ও অলি-আউলিয়াদের দাফনস্থলকে কবর বলা যাবে না এমন কোনো বিধান ইসলামী শরিয়তে নেই।
অলি-বুজুর্গদের কবরের জন্য কোরআন-হাদিসে কোথাও মাজার শব্দ ব্যবহার হয়নি।
হাদিসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবীদের দাফনস্থলকেও কবর বলা হয়েছে। এমনকি হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরকেও কবর শব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সহিহ বোখারিতে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ইহুদি ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। -সহিহ বোখারি
বর্ণিত হাদিসে নবীদের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়েছে।
অন্য আরেক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিজের ব্যাপারে বলেন, ‘আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। ’ -সুনানে আবু দাউদ
বর্ণিত হাদিসের আলোকে এটা বুঝা যায় যে, যতো সম্মানিত ব্যক্তিই হোক তার দাফনস্থলকে কবর বলা দোষণীয় নয়। তাই অলি-বুজুর্গদের দাফনস্থলকেও কবর বলা যাবে।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে কবরের সঙ্গে কৃত আচরণ। ইসলাম মনে করে, কবর ইবাদত বা উপাসনার স্থান নয়। কবর সংক্রান্ত যে সব বিষয় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন (যথা জিয়ারত, সালাম ও দোয়া) সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছু করা বৈধ নয়।
কবরকে সিজদা করা, চুমু খাওয়া, তাতে বাতি জ্বালানো- এগুলো বড় গোনাহ ও শিরকি কাজ। এ বিষয়ে ইসলামী শরিয়তের অনেক দলিল রয়েছে।
সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মত নিজ নবী ও বুজুর্গদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার স্থান বানাবে না। আমি তোমাদের এ কাজ করতে নিষেধ করছি। ’ -সহিহ মুসলিম
অন্য আরেক হাদিসে কবরের ওপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের ওপর হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। -সুনানে তিরমিজি
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলীকে (রা.) এই ফরমান দিয়ে পাঠালেন যে, কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমান করে দেবে এবং কোনো মূর্তি দেখলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। ’ -জামে তিরমিজি
ইসলামী আইনের প্রসিদ্ধ কিতাব তাহতাবি আলা মারাকিল ফালাহ’তে (৩৪১ পৃ.) বলা হয়েছে, ‘কবর মুছবে না, কবরে চুমু দেবে না এবং কবরকে স্পর্শ করবে না। কেননা, এটা নাসারাদের (খ্রিস্টান) রীতি।
উল্লেখ্য যে, কবরে চুমু খাওয়া, সিজদা করা, তাওয়াফ করা, কবরের ওপর ইমারত বানানো, গিলাফ চড়ানো, মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ইত্যাদি একদিকে যেমন শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ, অপরদিকে তা কবরবাসী অলি-আউলিয়াদের প্রতি চরম অবিচার।
কেননা, তারা পুরো জীবন শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন অথচ মৃত্যুর পর তাদের প্রতি ভক্তি নিবেদনের নামে ওই সব কাজ করা হচ্ছে! প্রকৃতপক্ষে সাহাবা, তাবেয়িন এবং অলি-বুজুর্গদের পথ-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের ঈমান-আমল ঠিক করা, তাওহিদ ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা এবং শিরক-বিদআত ও সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই তাদেরকে প্রকৃত সম্মান করা হয়।
কবর জিয়ারতের সুন্নত তরিকা হলো- কবরের কাছে গিয়ে সালাম দেওয়া।
এরপর কবরকে পেছনে রেখে কিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য এবং কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা।
এছাড়া কোরআনে কারিম থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করে কবরবাসীর জন্য ইসালে সওয়াব করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৩
এসআরএস