গুনাহর কাজ সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। তবে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ স্থানে যেমন নেক আমলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, তেমনি গুনাহর তীব্রতাও তৈরি হয়।
কারণ, পবিত্র স্থান ও ক্ষণে গুনাহ করা সাধারণ স্থানে বা স্বাভাবিক অবস্থায় গুনাহ করার চেয়ে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ।
এ কারণে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব এই মাসগুলোতে যে নিজের ওপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীলতা ও পাপাচার এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
নিম্নে এমন কিছু গুনাহর বিষয় উল্লেখ করা হলো, যেসব গুনাহ অবহেলা বা অজ্ঞতাবশত হজের সফরে অনেকের হয়ে থাকে।
পর্দা ও নজরের হেফাজত
পর্দা ও নজরের হেফাজতের বিধান সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য। তবে হজের সফরে যেহেতু নারী-পুরুষের বিশাল জমায়েত হয়ে থাকে, তাই তখন বিশেষভাবে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য বেশি পবিত্রতা। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
আর যা সাধারণত প্রকাশ পায়, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত রাখে। ... আর যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। ...’ (সুরা : নুর, আয়াত ৩০-৩১)
দৃষ্টির হেফাজত করা না হলে অনেক সময় তা চোখের জিনার পর্যায়ে চলে যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহ বনি আদমের কপালে বিভিন্ন স্তরের জিনা-ব্যভিচার লিখে রেখেছেন।
তন্মধ্যে চোখের জিনা হলো কুদৃষ্টি দেওয়া, মুখের জিনা হলো অবৈধ আলাপ, অন্তরের জিনা হলো কুখেয়াল ও অবৈধ কল্পনা করা আর সবশেষে লজ্জাস্থান তা বাস্তবে পরিণত করতে পারে অথবা পারে না। (বুখারি, হাদিস : ৬৬১২)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, বিদায় হজের সফরে ফজল ইবনে আব্বাস (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বাহনে পেছনে বসা ছিল। এ অবস্থায় এক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতে এলে ফজল তার দিকে তাকিয়েছিল এবং ওই নারীও বারবার ফজলের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। ... (বুখারি, হাদিস : ১৮৫৫)
নারীদের ব্যাপকভাবে নেকাববিহীন চলাফেরা
ইহরাম অবস্থায় নারীদের চেহারা না ঢাকার বিধানকে কেন্দ্র করে একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় চেহারায় নেকাব ব্যবহারকারী অনেক দ্বিনদার মহিলাও ইহরাম অবস্থায় পরপুরুষের সামনে নেকাববিহীন চলাফেরা করে। অথচ এই পর্দাহীনতা একটি ভুল কাজ। কেননা ইহরাম অবস্থায় চেহারায় কাপড় দেওয়ার নিষিদ্ধতা অবস্থায়ও পরপুরুষের সামনে বেপর্দায় যাওয়া নিষিদ্ধ। তাই পরপুরুষের নজরের আওতায় থাকলে এমনভাবে চেহারা ঢাকতে হবে, যেন চেহারার সঙ্গে নেকাবের কাপড়টি না লাগে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৮৮)
বর্তমানে এ উদ্দেশ্যে ক্যাপবিশিষ্ট বিভিন্ন নেকাব বাজারে পাওয়া যায়, তা ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর উভয় বিধান পালনে সমন্বয়সাধন সম্ভব।
সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে এমন আমল পাওয়া যায়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা ইহরাম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। যখন পুরুষদের কাফেলা আমাদের পাশ দিয়ে যেত, তখন আমরা আমাদের চেহারার নেকাব ঝুলিয়ে দিতাম। যখন তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যেত, তখন নেকাব সরিয়ে নিতাম। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৮৩৩, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৪০২১)
নারী-পুরুষের নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রী উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আমি অসুস্থতার কারণে হেঁটে তাওয়াফ করতে অক্ষম হয়ে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানালাম। তিনি আমাকে বলেন, তুমি আরোহণ অবস্থায়ই মানুষের সর্বপেছন দিয়ে তাওয়াফ করো। তাই আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বাইতুল্লাহর পাশ ঘেঁষে নামাজ পড়াচ্ছিলেন তখন তাওয়াফ করি। ... (বুখারি : হাদিস ১৬১৯)
হাদিসটির ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেন, মানুষের পেছনে তাওয়াফের নির্দেশ দেওয়ার কারণ হলো—মহিলাদের তাওয়াফের নিয়ম হচ্ছে, পুরুষের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তাওয়াফ করবে। তাই তিনি পর্দার সুবিধার্থে সবার নামাজ অবস্থায় তাওয়াফ করেছিলেন। (উমদাতুল কারি ৯/২২৬)
একটি দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—ইবনে জুরাইজ (রহ.) বলেন, আমি আতা (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পরও নারীরা কিভাবে পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে তাওয়াফ করতেন? আতা (রহ.) বলেন, নারীরা পুরুষের সঙ্গে মিশতেন না; বরং দূরত্ব বজায় রাখতেন। আয়েশা (রা.) পুরুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তাওয়াফ করতেন। ... যখন পুরুষরা কাবাঘর থেকে বের হয়ে যেত, তখন নারীরা প্রবেশ করতেন। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করল, আয়েশা (রা.) কিভাবে পর্দা রক্ষা করেছেন? আতা (রহ.) বলেন, তিনি পর্দাবৃত একটি তুর্কি পালকি বা তাঁবুর ভেতরে থাকতেন। (বুখারি, হাদিস : ১৬১৮)
ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে নারীদের পুরুষদের সঙ্গে মিশে তাওয়াফ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। জনৈক পুরুষকে নারীদের মধ্যে দেখতে পেয়ে তাকে বেত্রাঘাতের মাধ্যমে সতর্ক করেছিলেন। (ফাতহুল বারি : ৩/৪৮০)
খানাপিনার অপচয়কে স্বাভাবিক মনে করা
হজের সফরে অনেককেই খাবার নষ্ট করতে দেখা যায়। অথচ খাবার নষ্ট করা মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পানাহার করো; কিন্তু অপচয় করবে না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
খাদ্যের সঠিক ব্যবহারে রাসুলুল্লাহ (সা.) অসংখ্য নির্দেশনা দিয়েছেন। খাওয়ার পর বাসন ও আঙুল চেটে খাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আহার শেষে তিনবার আঙুল চেটে খেতেন এবং বলতেন, তোমাদের বাসন থেকে কিছু পড়ে গেলে উঠিয়ে পরিষ্কার করে খেয়ে নাও, তা শয়তানের জন্য ছেড়ে দিয়ো না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৪৫)
মুসল্লিদের সামনে দিয়ে সুতরাবিহীন অতিক্রম করা
তাওয়াফকারীরা ছাড়া অন্যদের জন্য সুতরাবিহীন মুসল্লিদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। কিন্তু হারামাইনে ব্যাপকভাবে সবাইকেই মুসল্লিদের সামনে দিয়ে চলতে দেখা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি নামাজের সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী জানত যে এটি তার জন্য কত ক্ষতিকর তাহলে সে চল্লিশ দিন বা মাস কিংবা বছর (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত। ’ (বুখারি : হাদিস ৫১০)
শুধু বাইতুল্লাহর তাওয়াফকারীরা ওই বিধান থেকে ভিন্ন। এ ভিন্নতা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই শুধু তাওয়াফকারীর জন্য নামাজিদের সামনে দিয়ে সুতরাবিহীন অতিক্রম করা জায়েজ। মুত্তালিব ইবনে আবি ওয়াদাআ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মসজিদে হারামের বনি সাহম দরজার পাশে নামাজ পড়তে দেখেছিলেন, যে অবস্থায় তাওয়াফকারীরা তাঁর সামনে দিয়ে সুতরাবিহীন অতিক্রম করছিল। (আবু দাউদ, হাদিস : ২০১৬, শরহু মুশকিলিল আসার, হাদিস : ২৬০৭)
ইমাম তহাবি (রহ.) লিখেন, এ হাদিসে তাওয়াফকারীদের জন্য নামাজিদের সামনে দিয়ে সুতরাবিহীন অতিক্রম করার বৈধতা প্রমাণিত। এর কারণ হচ্ছে, তাওয়াফকারীদের সমস্যা ও জটিলতা থেকে বাঁচানো, তা না হলে মসজিদে হারামের মুসল্লি ও তাওয়াফকারীরা জটিলতায় পড়বেন। (শরহু মুশকিলিল আসার ৭/২৩, ২৭)
কিন্তু তাই বলে তাওয়াফকারী ছাড়া অন্যদের জন্যও এটি বৈধ হবে না। কেননা অন্যদের ক্ষেত্রে ওই সমস্যা নেই।
সেলফি ও ছবি তোলার হিড়িক
আজকাল হজের সফরে সর্বত্র সেলফি ও ছবি তোলার হিড়িক চলছে। বাইতুল্লাহকে পেছনে রেখে তাওয়াফ ও ইবাদত অবস্থায় অসংখ্য সেলফি তোলা হচ্ছে। এতে ইবাদতের নিমগ্নতা ও আত্মনিবেদন নষ্ট হয়। আল্লাহর ভয়ভীতি ও ভালোবাসা সব হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছবি-ভিডিওর নিমগ্নতার মধ্যে। অথচ ছবির নিষিদ্ধতার ব্যাপারে ইসলামে কঠোর বিধান রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই কিয়ামত-দিবসে ছবি ও প্রতিকৃতি তৈরিকারী সবচেয়ে কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৫০)
বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২৪
এসএএইচ