ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ ও কোরআনের শিক্ষা

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫
সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ ও কোরআনের শিক্ষা

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করার নিমিত্তে বিভিন্ন নিয়মকানুন প্রবতির্ত হয়েছে। এসব নিয়মকানুনের কাযর্কারিতা সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রচুর আলোচনা-পযার্লোচনা হয়।

আলোচনায় ওই নিয়মসমূহ কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। চিরায়ত সেসব নিয়মকানুন মেনে চলাই হচ্ছে- নৈতিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ।

বতর্মান সময়ে প্রায় সব বয়সীদের মধ্যে নৈতিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে একটা পরস্পর বিরোধী অসন্তোষ বিরাজমান। বয়স্করা তরুণদের ওপর ক্ষুব্ধ যে- তারা মুরুব্বিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে জানে না। আর তরুণরা আক্ষেপ করে বলে মুরুব্বিরা তাদের সব কিছুতেই বাঁধা দিয়ে থাকে, নাক গলায়। শহরকেন্দ্রিক সমাজে এই সমস্যাটা বেশি নজরে পড়ে। গ্রাম পযার্য়ে প্রত্যেকেই মোটামুটি পরস্পর পরিচিত- তাই সমস্যা তুলনামূলক কিছুটা কম। তার পরও নেই- তা বলা যাবে না।

কি গ্রাম কি শহর- এখন উঠতি বয়সের তরুণদের রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপট সবর্জনবিদিত। তাদের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তাদের ভাষা ও ইঙ্গিত শিষ্টাচারের সীমানা অতিক্রম করছে। পরিবার ও সমাজ থকে শুরু করে সবর্ত্রই ছড়িয়ে পড়ছে অশ্রদ্ধার চর্চা। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমাজের সবর্ত্রই দেখা যায়- কারও স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে যাচ্ছেতাই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আর এসব হচ্ছে পারস্পরিক সম্মান, সহমমির্তা ও শ্রদ্ধাবোধের অভাবের কারণে। অথচ এই কয়েকটা শব্দের স্বার্থক ব্যবহার হলে- সমাজসংসার হয়ে উঠত শান্তিময়। যখন এসবের ব্যতয় ঘটে তখনই শুরু হয় পারস্পরিক অবিশ্বাস আর রেষারেষি। কিন্তু কেন এই শ্রদ্ধাহীনতা? কেন পারস্পরিক সম্মান আর মূল্যবোধের সংস্কৃতি থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি? এর সামাজিক-রাজনৈতিক কারণই বা কী? নতুন প্রজন্মের ওপর এর প্রভাবই বা কী? এর কী কোনোই সমাধান নেই?

ইসলাম একটি সাবর্জনীন জীবনাদর্শ। যা মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়। এর মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, ধন-সম্পদ ও মান-মযার্দা সংরক্ষিত হয়। আসলে অন্যকে সম্মান করার মধ্য দিয়েই অজির্ত হয় মহৎ গুণ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আদর্শ সমাজ। এর বিপরীত চর্চা শুরু হলে বিপন্ন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পারস্পরিক অশ্রদ্ধার কোনো সুফল নেই। কেননা অশ্রদ্ধা ক্রমশঃ মানুষকে সহিংসতা আর পাশবিকতার দিকে ঠেলে দেয়। কাজেই এই অশ্রদ্ধা চর্চার সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বজর্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ ও শিক্ষিত বিবেকবানগণ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক উন্নয়নকে দীঘর্মেয়াদী ও টেকসই করার জন্য রাজনীতি, সমাজ, পরিবার, অফিস-আদালতসহ সবখানে পুনরায় সহিষ্ণু, উদার ও শ্রদ্ধার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ইসলাম এ বিষয়ে বেশ কার্যকর রাস্তা প্রদর্শন করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের সূরা হুজরাতে মুসলমানদের করণীয় বিভিন্ন সদাচরণের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। সেখানে সামাজিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত, সুসংহত এবং সুরক্ষিত করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে এই সূরা হতে পারে মুসলমানদের জন্য পরম পাথেয়, পথ নির্দেশক।

আসলে ইসলামি মূল্যবোধের সৌন্দর্য হচ্ছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস প্রদর্শন- যা প্রত্যেকের কর্তব্য বলে মনে করা হয়। একজন মুসলিম তার প্রতিপালকের প্রতি কেমন মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি রাখবে। তার আচরণ কিভাবে নির্ধারণ হবে এবং কিভাবে প্রভাবিত করবে তার এবং হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) সম্পর্ককে। তার এবং সমাজে বসবাসকারী অন্যান্যদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আচরণ কেমন হওয়া উচিত- এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই সূরায়।

এ সূরার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলমানদের এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেওয়া যা তাদের ইমানদারসূলভ স্বভাব চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই হয়। আল্লাহ ও তার রাসূলের ব্যাপারে যেসব আদব-কায়দা ও শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এই সূরার প্রথম পাঁচ আয়াতে তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি খবর বিশ্বাস করা এবং সে অনুসারে কোনো কর্মকাণ্ড করে বসা ঠিক নয়, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো খবর পাওয়া যায়- তাহলে প্রথমে ভেবে দেখতে হবে খবর পাওয়ার মাধ্যম নির্ভরযোগ্য কি না। নির্ভরযোগ্য না হলে তার ভিত্তিতে কোনো তৎপরতা চালানোর পূর্বে খবরটি সঠিক কি না তা যাঁচাই-বাছাই করে নিতে হবে। এই সূরায় আরও বলা হয়েছে, মুসলমানদের দু’টি দল যদি কোনো সময় পরস্পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তবে সে ক্ষেত্রে অন্য মুসলমানদের কর্মনীতি কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে। সূরা হুজরাতে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদেরকে ওইসব খারাপ অভ্যাস থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন, যা সমাজজীবনে নানা বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং যার কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়। তন্মধ্যে- একে অপরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, বদনাম ও উপহাস করা, খারাপ নামে আখ্যায়িত করা, খারাপ ধারণা পোষণ করা, অন্যের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি ও অনুসন্ধান করা, অসাক্ষাতে মানুষের বদনাম করা। বস্তুত এসব কাজ মারাত্মক পাপের এবং তা সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

আল্লাহতায়ালা এসব মন্দ কাজগুলোকে নাম ধরে ধরে নিষেধ করেছেন। অতঃপর বংশগত বৈষম্যের ওপর আঘাত হানা হয়েছে- যা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও বংশের নিজ নিজ মর্যাদা  নিয়ে গর্ব ও অহঙ্কার করা, অন্যদেরকে নিজেদের চেয়ে নিচু মনে করা এবং নিজেদের বড়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের হেয় করা, এসব এমন জঘন্য অভ্যাস- যার কারণে পৃথিবীতে অশান্তি বিরাজমান। সূরা হুজরাতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মানুষের আচরণ-আচরণ কেমন হবে- তা শিক্ষা দিয়েছেন। যে শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।