সৌদি আরবের বাদশা এবং বিশ্বের বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সউদ গত বৃহস্পতিবার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক বাদশাহ।
নানা বিতর্ক থাকলেও বাদশা আবদুল্লাহ ছিলেন একজন দক্ষ শাসক, দূরদর্শী সংস্কারক এবং একজন শান্তিবাদী ও সহমর্মী মানুষ। দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নয়নে একজন দরদী অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গেছেন বরাবরই। নারী ও পুরুষদের শিক্ষা উন্নয়নে তিনি সমান মনোযোগী ছিলেন। শিক্ষা উন্নয়নে স্কলারশীপসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজের ক্ষেত্রে তিনি ইসলামের নীতি, সমকালীন বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইতিহাসের কঠিন এক সময়ে তিনি ইসলামের উৎস ভূমি সৌদি আরবের শাসকের দায়িত্ব পালন করেন। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর একটি মহল সৌদিসহ ইসলামকে চরমপন্থী ও অসহনশীল এবং মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। গোটা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে ঝড় তোলা হয়। এ সময় বাদশা আবদুল্লাহ একদিকে তার নিজের দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিথ্যা অপপ্রচার অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যাবতীয় অপবাদ মোকাবিলায় দৃঢ় ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে আন্তঃধর্ম সংলাপ তার একটি বড় উদ্যোগ। বাদশা আবদুল্লাহর উদ্যোগে স্পেনের মাদ্রিদসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সব ধর্মের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বাদশা আবদুল্লাহর উদ্যোগে ২০০৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে আন্তঃধর্ম সংলাপ নিয়ে আলোচনা করে এবং গৃহীত প্রস্তাবে আন্তঃধর্ম সংলাপকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এই সংলাপকে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে শান্তি ও সমঝোতার একটি মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা হয়। এই সংলাপ আয়োজনের পিছনে বাদশা আবদুল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, প্রকৃত রূপ পৃথিবীর সব মানুষ ও সব ধর্মের মানুষের সামনে নিয়ে আসা। এটা বাদশা আবদুল্লাহর একটি মহৎ উদ্যোগ ও কাজ। তিনি বিশ্বশান্তি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দুর্গত মানুষ, নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানসহ বিশ্বের সঙ্কট কবলিত মুসলমানদের জন্য উদার হাতে সাহায্য করেছেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন তহবিলেও তার অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।
বিপুল বিত্তশালী দেশের শক্তিমান শাসক হয়েও তিনি নিজের ধর্ম, নিজের সংস্কৃতি ও নিজেদের অতীত ভুলে যাননি। তিনি তাকে ‘ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি’ বলে সম্বোধন করা পছন্দ করতেন না। ‘খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন’ (মসজিদের হারাম ও মদিনার সেবক) সম্বোধনই তার কাছে প্রিয় ছিল। সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য তার হাত চুম্বন করাও তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি তার সন্তানদের ইসলামী আদর্শ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করেন।
সৌদি আরবে বেশ কিছু সংস্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় বাদশাহ আবদুল্লাহকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো নারীদের ভোটাধিকার প্রদান ও স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়নের সূচনা।
ইবনে সউদের ছেলেদের মধ্যে বাদশাহ আবদুল্লাহ ছিলেন ১৩তম। তিনি ২০০৫ সালের ১ আগস্ট রাজ্যভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১০ বছরে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি নিজের দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা, ২০০২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর হামলা, সর্বশেষ মিসরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে তিনি যা করেছেন তা অনেকেই কোনো হিসাবে আনতে পারেন না। তার পরও বলতে হয়, এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাদে মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নে তার অবদান মোটেও কম নয়। তিনি অনুন্নত আফ্রিকা মহাদেশে অসামান্য অনুদান দিয়ে সেখানকার মুসলিম জনপদের যে সেবা করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার যুদ্ধের সময় তিনি মুসলমানদের রক্ষার জন্য অকাতরে সাহায্য করেছেন। সবশেষ বিমান পাঠিয়ে তাদেরকে সৌদি আরবে আনার বিষয়টিও নিশ্চিত করে তাদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছেন।
সৌদি-বাংলা সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর বাংলাদেশের উন্নয়নে সৌদি আরব যেসব অবদান রেখেছে তার পেছনে বাদশাহ আবদুল্লাহর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বাংলাদেশের প্রতি সর্বদা বিশেষ নজর রাখতেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সৌদি গমন ও সেখানে ব্যবসা করার সুযোগ লাভ করে। বিভিন্ন দুর্যোগে মুসলমানদের সাহায্যে বাদশাহ আবদুল্লাহ ছিলেন উদারহস্ত। সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে বাদশাহ আবদুল্লাহ ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ‘সিডর’ নামক ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের জন্য তিনি বড় অংকের সাহায্য পাঠান।
২০১৩ সালে ৮ লক্ষাধিক বাংলাদেশীকে বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে সক্ষম হন। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৩৮ ভাগ সৌদি আরব থেকে আসে। তাছাড়া বিনা সুদে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, পদ্মা সেতু, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারসহ প্রায় ২০টি মেগা প্রকল্পে সৌদির অর্থায়ন রয়েছে। প্রতি বছর বহু সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক সৌদি সরকারের খরচে সেখানে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০০৯ সালে তিনি জেদ্দায় কিং আবদুল্লাহ সায়েন্স ও টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ অঙ্কের বৃত্তি দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ করে দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনে মুসলিম বিশ্বের ৫২ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে দাওয়াত দেন। এর আগে ২০০৮ সালে (১৪২৯ হিজরি সনে) প্রিন্সেস নূরা ইউনিভার্সিটি নামে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বিদেশি ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এ দু’টো প্রতিষ্ঠানেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এটা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য এক বিশাল পাওনা।
বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজকে দাফন করা হয়েছে আল-আউদ গোরস্তানের অজ্ঞাত কবরে। তার কবর যেন দর্শনার্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত না হয় সেজন্যই পূর্বসূরীদের মতো তার কবরের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি।
-আরব নিউজ ও সৌদি গেজেট অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময় : ১৮২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৫