মুখস্থ করার অভ্যাস সবার সমান নয়। সে হিসেবে বলা যায়, যারা পবিত্র কোরআনে কারিম মুখস্থ করেন তারা অবশ্যই প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন উদ্যোগে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বেশ কয়েকটি দেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বমানের হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা। এসব প্রতিযোগিতার মূল্যমান যেমন বিশ্বমানের, তেমন এর গুরুত্বও ভিন্ন।
ইসলামি সভ্যতা বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। রয়েছে আলাদা ঐতিহ্যও। সেই ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় স্বার্থকতার সাথে অংশগ্রহণ থাকেন বাংলাদেশের হাফেজরা।
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত প্রতিযোগিতার নাম ‘আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা। ’ এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বয়সী বাংলাদেশের হাফেজরা অত্যন্ত সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এসব প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা শীর্ষস্থান অধিকার করে দেশের সুনাম বয়ে আনছে। বিশ্বপরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের সুনাম ও খ্যাতি।
ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের ‘দ্বীনী দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগ’ বিভাগ থেকে দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুসারে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি হাফেজরা সৌদি আরব, দুবাই, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, মিশর, জর্দান, তুরস্ক, আলজেরিয়া, ভারত ও পাকিস্তানসহ প্রভৃতি দেশে আয়োজিত হিফজ, ক্বেরাত ও তাফসির প্রতিযোগিতায় প্রায় ১১০ জন হাফেজ, ক্বারী ও মুফাসসির বিভিন্ন মানের পুরস্কার অর্জন করেছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ সব পুরস্কারের আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা এবং প্রাপ্ত স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ ৩৫০ ভরি।
নিম্নে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বলকারী কয়েকজন চ্যাম্পিয়ন হাফেজের কাহিনি উল্লেখ করা হলো—
হাফেজা ফারিহা তাসনিম : বিশ্বের ৪৩টি দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বালিকা হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে বাংলাদেশি শিশু ‘হাফেজা ফারিহা তাসনিম। ’ ২০১৩ সালের ১৭ মে জর্দানের রাজধানী আম্মানে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ফারিহা তাসনিম মাত্র ছয় বছর বয়সে সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করেন। প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে সৌদি আরব ও তৃতীয় হয় লিবিয়ার প্রতিযোগী।
হাফেজ নাজমুস সাকিব : ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মক্কা নগরীর হারাম শরিফে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে ময়মনসিংহের ছেলে নাজমুস সাকিব। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ৭০টি দেশের প্রতিযোগী। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নাজমুস সাকিব কাবা শরীফের ইমাম আবদুর রহমান আস সুদাইসের হাত থেকে গ্রহণ করেন পুরস্কারস্বরূপ ৮০,০০০ সৌদি রিয়াল, বিশেষ সম্মাননা পদক ও সার্টিফিকেট।
এর আগে সাকিব ২০১২ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় এশিয়ার ২৭টি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। সাকিব ২০১৩ সালে এনটিভি-পিএইচপি কোরআনের আলো প্রতিযোগিতায়ও সাকিব প্রথম স্থান অর্জন করে প্রায় ২০ হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে। সাকিবের অর্জন এখানেই শেষ নয়। সে ২০১২ সালে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৯০টি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। পুরস্কার হিসেবে সাকিব পায় ৪৭ হাজার দিনার।
হাফেজ জাকারিয়া: মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ২১তম আন্তজার্তিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চর ইলামপুর গ্রামের কিশোর হাফেজ জাকারিয়া। ২০১২ সালে ৫০টি দেশের ক্ষুদে হাফেজদের পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে সে। ১২ বছর বয়সী জাকারিয়ার বাবার নাম মাওলানা ফয়জুল্লাহ। এর আগে সে ২০১১ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করে।
হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন: সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা ২০১৪ সালে প্রথম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশের গর্ব ১২ বছর বয়সী হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন। সৌদি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে হাইয়্যাতুল আলামিয়্যাহ নামের একটি সংস্থা এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিশ্বের ৭০টি দেশের প্রায় সাত হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে মামুন হয়েছেন প্রথম। মামুন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাসিন্দা।
২০১৪ সালের রমজান মাসে শুরু হয় এ প্রতিযোগিতা। মামুন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ১৮ হাজার রিয়াল। মামুনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মক্কার আমির আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ।
মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ: ‘বাদশাহ আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা’ বিশ্বের নামকরা একটি প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র মক্কা শরিফে। ২০১৩ সালে এ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। কালাম পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল। প্রতিযোগিতায় ৬১টি দেশের ১৫০ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল।
হাফেজ মহিউদ্দিন: ২০১২ সালের আগস্টে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হাফেজ মহিউদ্দিন ৬০টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
অন্ধ হাফেজ তানভির: ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত বিশ্ব হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৭৩টি দেশের মধ্যে ৩০ পারা গ্রুপে অন্ধ হাফেজ মুহাম্মদ তানভির প্রথম স্থান লাভ করে। ওই একই প্রতিযোগিতায় ১০ পারা গ্রুপে সাদ সুরাইল নামের অপর এক ক্ষুদে বাংলাদেশি হাফেজ প্রথম স্থান অধিকার করেন।
আসলে সবধরনের রেকর্ডই যে কোনো দেশের জন্য সুখকর। এভাবে বছরের পর বছর বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল অর্জনও বটে। এই অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ যেমন বিশ্বব্যাপী সম্মানিত হয়েছে, তেমনি স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব রেকর্ড বুকে। অর্জিত হয়েছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। আমার চাই বাংলাদেশি হাফেজদের এমন সফলতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। আরও বেশি বেশি সম্মান বয়ে আনুক। উজ্জ্বল করুক দেশের নাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘন্টা, মার্চ ০২, ২০১৫