যে নারীর স্বামী মৃত, তাকে বিধবা বলা হয়। বিধবা মানেই যন্ত্রণা।
অপেক্ষাকৃত দরিদ্র নারীদের এই সমস্যা আরও বেশি। এক কথায় সমাজের বিধবা নারীরা মর্যাদাগতভাবে প্রচুর বৈষম্য ও নানা উৎপীড়নের শিকার। তারা বিভিন্ন কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ ও অযৌক্তিক প্রথাগত বাধার সম্মুখীন। এই বাধার কারণে তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারে না। প্রায়ই দেখা যায়, অল্প বয়সে কোনো নারী বিধবা হলে সেই নারীর আবার বিয়ে দেওয়ার কথা অনেকে ভাবে না। ভাবে না তার নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের কথা। অথচ তারও নিজের জীবন বলে কিছু আছে।
আসলে সমাজ ও পরিবারকেই তা ভাবতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আনবে ইতিবাচক পরিবর্তন। এখানে হীনমন্যতার কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। বিধবা নারীর বিয়ে শরিয়ত অনুমোদিত কাজ। ক্ষেত্রবিশেষ সামাজিক, জাতীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করা শ্রেয় এবং তা অগ্রাধিকারের দাবি রাখে।
বিধবা বিয়ে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কারিমে নানাভাবে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম বলে, বিধবা নারী যাকে খুশি তাকে বিয়ে করতে পারবে। ইসলাম কোনো বিধবাকে ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখে না। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, 'আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং তাদের নিজেদের স্ত্রীদের রেখে যাবে, সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেরা চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা (ইদ্দত পালন) করবে। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতিসঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোনো পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে। ' -সূরা আল বাকারা : ২৩৪
যে নারীটির সমগ্র নির্ভরশীলতার জায়গা ছিল তার স্বামী, সেই স্বামীর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া তাকে যেন অথৈ সাগরে ফেলে দেয়। স্ত্রী খড়কুটো আঁকড়ে ধরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন। হাল ধরেন সংসারের। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পার করে দেন বছরের পর বছর। যেখানে একজন পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে পরিবার ও সমাজের লোকদের আফসোস-সহানুভূতির সীমা থাকে না। বছর না ঘুরতেই তাকে বিয়ে করানোর তোড়জোড় চলে, তিনি যে বয়সেরই হোন না কেন। তাকে বিয়ে করায় পরিবার।
কিন্তু কোনো নারীর স্বামী মারা গেলে তার একা থাকা নিয়ে ছিটেফোঁটা চিন্তা নেই অনেকের। চিরন্তন ভাবনা- একা থাকায় নারীর আবার কষ্ট কিসের? ছেলেমেয়ে আছে না! ওদের মানুষ করতে সময় কোথা দিয়ে পার হবে, টেরও পাবে না। একটু বয়স হওয়া, সন্তান বড় হয়ে যাওয়া মায়েদের ক্ষেত্রে তো এমনটি ভাবা রীতিমতো অপরাধ। কিন্তু খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া নারীর ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি তো আমরা ভাবতে পারি। এ ভাবনা কি বেশি অমূলক?
বিধবা নারীর বিয়ের ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনেরই বেশি আপত্তি লক্ষ্য করা যায়। বলা হয়, সন্তানরা বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন এটা কীভাবে মানা যায়? আসলে এটা কোনো যুক্তিযুক্ত কথা নয়। বিধবা নারী তার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি যদি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তা পূরণ করাই হবে যথার্থ কাজ। এখানে দেখতে হবে প্রয়োজন ও চাহিদা। বস্তুত প্রয়োজন ও চাহিদার কারণে এমন অনেক কাজই করতে হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে সামাজিক রীতিনীতি ও ভালোবাসা-বিরুদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে কাজটিকে সামাজিক রীতি ও ভালোবাসার সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হবে না। প্রয়োজনের সঙ্গে ভালোবাসা ও সামাজিক রীতির কিসের সংঘাত?
আসলে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীর শোকে কাতর হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। নিরাপদ আশ্রয় ও মানবিক মর্যাদা হারানোর কারণে সমাজ-সম্প্রদায়ে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণও তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। একজন বিধবা নারী তার উত্তরাধিকার সম্পত্তি, সন্তান, স্বামী, সংসার, দেনমোহর, নিরাপদে কাজ করা, সমাজের কাছে সাহায্য পাওয়া, সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু তারা এই অধিকারগুলো পাচ্ছেন না। একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে ধরনের মর্যাদা প্রয়োজন তা বিধবা হওয়ার মধ্য দিয়ে হারাতে হয় এবং রাষ্ট্রীয় কোনো প্রচেষ্টাও তাদের জন্য পরিলক্ষিত হয় না। পরিবার এবং সমাজে তাদের প্রতি যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি সে কারণে তারা নিজেরাও নিজেদের গুরুত্বহীন বলে মনে করেন, ভাগ্যকে দায়ী করেন। এমতাবস্থায় বিধবা নারীদের চাহিদা মোতাবেক তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, বিধবা মানেই অভিশাপ নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭ ঘন্টা, মার্চ ০৩, ২০১৫