ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

স্মরণ

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.

‘বেহেশতি জেওর’ বাড়িতে নেই এমন ঘর আমাদের সমাজে বিরল। ‘খুতবাতে আহকাম’ মিম্বরে নেই এমন মসজিদও তেমন একটা দেখা যায় না।

‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’ বুক সেলফে নেই এমন কোনো ফতোয়া বিভাগ পাওয়া যায় না। ‘বয়ানুল কুরআন’ নেই এমন কোনো তাফসির বিভাগ কেউ দেখেনি। ‘আন নাশরুত্ তীব’ সংরক্ষিত নেই এমন কোনো সীরাত গবেষণাগারও পাওয়া যাবে না।

উপরোক্ত বহুল পঠিত গ্রন্থাবলীর সংকলক ও লেখক হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-কে চিনে না এমন মুসলমান নেই বললেই চলে। তিনি ভারতের থানাভবনের নিবাসী হওয়ার কারণে তার নামের শেষে ‘থানভী’ যোগ করা হয়। সমকালীন যুগের হাজার হাজার মানুষ তার কাছ থেকে আত্মশুদ্ধি এবং তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করার কারণে তিনি ‘হাকিমুল উম্মত’ (উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক) উপাধিতে ব্যাপকভাবে পরিচিত।

আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন বহুমুখি প্রতিভার জীবন্ত প্রকাশ। তিনি লিখেছেন। প্রচুর লিখেছেন, তার গ্রন্থ সংখ্যা সহস্রাধিক। তিনি এক জীবনে যা লিখেছেন আমরা কয়েক জীবনে তা পড়েও শেষ করতে পারব না। তিনি লিখেছেন বিদগ্ধ পন্ডিত গবেষক আলেমদের জন্য গবেষণার খোরাক। আবার তিনি লিখেছেন সমাজের পিছিয়ে থাকা অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ সরল ও সাবলীল গ্রন্থ। পেটের তাগিদে বা লেখক খ্যাতির মোহে তিনি লেখেননি। নিজের লেখার কোনো রয়্যালিটি তিনি গ্রহণ করতেন না। এমনকি তিনি লেখকস্বত্ব বা মেধাস্বত্বও সংরক্ষণ করতেন না। সকল রচনা ও গ্রন্থাবলীর প্রকাশনা সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলেন।

জনসাধারণের কোথায় সমস্যা, কী কী কুসংস্কার আর বাড়াবাড়িতে জনসাধারণ নিমজ্জিত- এগুলো তিনি দিলের দরদ দিয়ে অনুধাবন করতেন আর মনের মমতা দিয়ে লিখতেন। কুসংস্কারমুক্ত আলোকিত সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। এ স্বপ্নের জন্য তিন কাজ করতেন। শুধুই কি তিনি লিখেছেন? না। তিনি জ্ঞান পিপাসু ছাত্রদের পাঠদান করেছেন। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। আবার দ্বীনবিমুখ সাধারণ মুসলমানদের মাঝে দ্বীনের চেতনা জাগ্রত করার জন্য তিনি গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে ছুটে যেতেন। সর্বশ্রেণির মাঝে তিনি ওয়াজ-নসিহত করতেন। সহজভাবে ইসলামের সৌন্দর্য মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। শাণিত যুক্তি দিয়ে ইসলামি বিধানের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতেন। তিনি ওয়াজের জন্যও কোনো হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। নিছক দ্বীনী খেমদত ছিল তার ওয়াজের প্রেরণা। আবার তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ সাধক, তাপস, দরবেশ। চিশতিয়া তরিকার একজন কামেল পীর ও মুর্শিদ। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ তার মুরিদ ছিল। কিন্তু পীর-মুরিদি দ্বারা তিনি দুনিয়াবি কোনো ফায়দা ভোগ করতেন না। গরু-ছাগলসহ হাদিয়ার কোনো প্রথা তার দরবারে ছিল না। কোনো ভুরিভোজের আয়োজন সেখানে হত না। মানুষ তার কাছে আসত তাসাউফের সবক শিখতে। তিনি উদার মনে মানুষকে তাসাউফ শিখাতেন। জিকির-আজকারসহ চিশতিয়া তরিকার যাবতীয় সবকের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ছিল তার খানকার বৈশিষ্ট্য। যারা তার কাছে মুরিদ হত তারা পত্রযোগে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। নিজেদের অবস্থা তাকে জানত। তিনি কষ্ট করে সবার চিঠি পড়তেন আবার পরামর্শ দিয়ে জবাবও লিখে পাঠাতেন।

আলোকিত মানুষ গড়ার এমন একজন চিন্তাবীর মুক্তমনা কারিগরের জন্ম হয়েছিল ১২৮০ হিজরির ৫ রবিউস সানী মোতাবেক ১৪ মার্চ ১৮৬২ খিস্টাব্দের বুধবার সুবহে সাদেকের সময়। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন তার জন্ম তারিখে ১৯ আগস্ট। ভারতের যুক্ত প্রদেশের মুজাফ্ফরনগর জেলার থানাভবন শহর তার জন্মস্থান। তার পিতা জনাব আবদুল হক ছিলেন ফারসি ভাষার সুপন্ডিত ও লেখক এবং মিরাঠের এক বিরাট জমিদারের নায়েব।

তিনি বাল্যকালেই পবিত্র কোরআনের হাফেজ হন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন নিজ শহরে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ১২৯৫ হিজরিতে বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপিঠ দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। ১৩০০ হিজরিতে দেওবন্দ থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে আনুষ্ঠানিক ছাত্রজীবনের ইতি টানেন।

জাহেরি জ্ঞানের পাশাপশি বাতেনি জ্ঞানের প্রতিও তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। তাই কর্মজীবনের প্রথম বছরেই ১৩০১ হিজরি সালে পবিত্র হজ গমন করে মক্কা শরীফে অবস্থিত চিশতিয়া তরিকার জগৎনন্দিত পীর হাজী এদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি (রহ.)- এর হাতে বায়াত হন। জিকির, শোগল, রিয়াজত, মোজাহাদা দ্বারা শুরু করেন এলমে বাতেনের অনুশীলন। চিশতিয়া তরিকার সকল ঘাঁটি ও স্তর অতিক্রম করে এবং সকল বাতেনি গুণ ও যোগ্যতা অর্জন করে ১৩১১ হিজরিতে স্বীয় শায়েখ ও মুর্শিদ হাজী সাহেব থেকে চিশতিয়া তরিকার খেলাফত লাভে ধন্য হন।

১৩০১ হিজরি সনে কানপুর ফয়জে আম মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। কয়েক বছর পর সেখানে ইস্তেফা দিয়ে কানপুরের জামিউল উলুমে অধ্যাপনা শুরু করেন।

১৩১৫ হিজরিতে কানপুর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ শহর থানাভবনে এসে এলমে জাহের ও বাতেনের সামগ্রিক খেদমত শুরু করেন।

তার অসাধারণ প্রজ্ঞা, এলমি ও রূহানি খেদমত এবং মুসলিম উম্মাহর প্রতি তার সংস্কারমূলক অসামান্য অবদানের কারণে তাকে হাকিমুল উম্মত ও মুজাদ্দেদে মিল্লাত খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার রচনা ও বক্তৃতার প্রতিটি ছত্রে মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে থাকা কুফর, শিরক, বিদআত, কুসংস্কার এবং আত্মিক দুর্বলতা ও ব্যধিসমূহের রিপোর্ট ও তার চিকিৎসা সহজভাবে বর্ণিত হয়েছে। এগুলো থেকে মুসলিম উম্মাহ শতাব্দীর পর শতাব্দী উপকৃত হবে।

১৩৬২ হিজরির ১৬ রজব বুধবার রাতে এ মহান সাধক কর্মবীর যুগসংস্কারক ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে পরকালের শুভ যাত্রা শুরু করেন। তিনি তার আদর্শ ও কর্ম দ্বারা আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে বেহেশতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘন্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।