দেখতে দেখতে বছর ঘুরে অাবারও দুয়ারে হাজির পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশে দিনটিকে বরণ করা হয় বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে।
হালখাতা ফারসিজাত শব্দ। হালখাতার অনুষ্ঠানটি ধর্ম প্রভাবান্বিত কোনো অনুষ্ঠান নয়। এটা নিতান্তই ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা কৌশলমাত্র। ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম। ’ আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজে ব্যবসায়ী ছিলেন। এ জন্যে মুসলমান মাত্রই ব্যবসাকে হালাল রুজির একটি অন্যতম পবিত্র মাধ্যম বলে মনে করেন।
হালখাতা ছাড়াও অনেক মুসলমান ব্যবসায়ী- ব্যবসায় সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্যে বছরের শুরুর দিন তাদের দোকান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দোয়া অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। ওই দোয়া অনুষ্ঠানে সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা, ইসলামে ব্যবসার নীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আলোচনা এবং মোনাজাত শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
এভাবেই বছরের প্রথম দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ শুরুর একটা আনুষ্ঠানিকতা ঘোষিত হতো যার যার রীতিতে। বস্তুত এসব অনুষ্ঠান মানুষরে মন-মগজে এক ধরনের পবিত্রতার আমেজ এনে দেয়।
তবে হালখাতা যে বৈশাখের প্রথম তারিখেই করতে হবে এমন কোনো ধরা বান্দা নিয়ম ছিল না; বরং যার যার সুবিধা মতো বৈশাখের যে কোনো তারিখে পালন করা হতো। পূর্ব যুগে বৈশাখ উদযাপনের আরেকটি কারণ ছিল, ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের বিরোধিতা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে সংঘবদ্ধ করা, কিন্তু গত দুই দশকে এর কাঠামোতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
আমরা জানি, ব্যবসা চালাতে গিয়ে অনেক সময় বাকীতে মালামাল বিক্রি করতে হয়, এ ধারা সম্ভবত পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই চলে আসছে। তবে যে পরিমাণ বাকীই থাকুক না কেন, এটা পরিশোধ করতে হবে পহেলা বৈশাখের আগে। কেননা কোনো ব্যবসায়ী পুরনো খাতার বকেয়ার হিসাব নতুন খাতায় তুলতে চান না। এভাবে বছরের প্রথম দিন থেকে খোলা হয় নতুন খাতা, যাকে বলা হয়- হালখাতা। আর এ খাতা খোলার দিন আয়োজন করা হয়- হালখাতা নামক অনুষ্ঠানের। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত লোকজন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। যাদের বকেয়া আছে তারা বকেয়া পরিশোধ করেন আর যাদের বকেয়া নাই তারাও কুশল বিনিময় করতে আসেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আগতদের মিষ্টি মুখ করানো হয়। ইদানিং বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকও তাদের বকেয়া আদায়ে হালখাতা অনুষ্ঠানের প্রথা অনুসরণ করছে; যা সচেতনতার পরিচয় বহন করে।
একটা সময় পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর এসব কাজে ইসলামি শরিয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘিত হতো না বিধায়- এসবকে ইসলামে নিষিদ্ধ বলার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এমন কিছু কর্মকান্ড সংঘটিত হয়, যা কখনোই পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালীরা করেননি; বরং এর অধিকাংশই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে প্রচণ্ডভাবে সাংঘর্ষিক। তাই এসব নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে ইসলামী স্কলারদের। তাদের অভিমত হলো, ‘যে সব উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতা একজন মুমিনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ ঈমানকে বিনষ্ট করে সে উৎসব ও অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। ’
বর্তমানের হালখাতায় বিশাল টাকা খরচ করা হয়, সেই সঙ্গে থাকে নানা ধরনের আনন্দের ব্যবস্থা। যার অধিকাংশই বাহুল্য খরচ। এটা ইসলাম অনুমোদন করে না। ক্ষেত্রবিশেষ এমনও অভিযোগ শোনা যায় যে, হালখাতার বকেয়ার হিসাব আর বাস্তবে বাকীর হিসাবে নাকি প্রচুর গড়মিল থাকে। যদি বাস্তবতা এমনই হয়, সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। এসব প্রতারণা ও ধোঁকা। ইসলামে প্রতারণা ও ধোঁকা নাজায়েজ। আর এমন রোজগার হারাম।
ইসলাম যেমন ব্যবসায় বাকী দিতে নিষেধ করেনি, তেমনি প্রতারণার পথে যেতে পারে এমন বিষয়েও কৌতুহল দেখাতেও উৎসাহ দেয়নি। এর অর্থ হলো, ব্যবসার কারবারে সর্বোতভাবে সততা বজায় রাখতে হবে, সন্দেযুক্ত কোনো উপার্জন ভোগ করা যাবে না। সেই সঙ্গে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কোনো রীতি গ্রহণ ও পালন করা যাবে না। এসব প্রথা-পদ্ধতি থেকে বিরত থাকা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একান্ত ধর্মীয় দায়িত্ব। আশা করি সচেতন মুসলমানরা বিষয়টি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করবেন।
শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সেই লোক ভালো যার লেন-দেন ভালো। ’ এই হাদিসের শিক্ষা মুসলমান তো বটেই ধর্ম নির্বিশেষে সব লোকই কম-বেশ পালন করার চেষ্টা করেন। আর হালখাতা করা হয় ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে। সুতরাং প্রচলিত হালখাতায় যদি শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ না করা হয়, তাহলে এটা জায়েজ। মনে রাখতে হবে, হালখাতার নামে কোনো প্রকার প্রতারণা, জুলুম করা যাবে না।
ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধুমাত্র পাওনা টাকা আদায়ের লক্ষ্যে হালখাতা বৈধ। কারণ, ইসলাম মনে করে হাজার টাকা দান করার চেয়ে সামান্য পরিমাণ ঋণ পরিশোধের বেশি ফজিলত। ঋণ একটি অভিশাপ। ঋণে যতকম জড়ানো যায়, ততই মঙ্গল।
যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করে, অন্যের অর্থকে নিজের অর্থ হিসেবে মনে করে, তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে, অন্যের টাকায় বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, নিজের জীবনধারাকে উন্নত করার জন্য অন্যের কষ্টের কারণ হয়, এরূপ উচ্চাভিলাষী ও অন্যের অধিকার হরণকারীদের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এদের অত্যাচারীরূপে এবং ঋণ পরিশোধে এদের টালবাহানাকে জুলুম বলে আখ্যায়িত করেছে। এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ঋণ পরিশোধে সচ্ছল ব্যক্তির টালবাহানা জুলুম। ’
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়তেন না, যার ওপর ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘন্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৫
এমএ