ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

আল্লাহর সন্তষ্টিই রোজা পালনের লক্ষ্য

প্রফেসর আবুল হাশেম, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৫
আল্লাহর সন্তষ্টিই রোজা পালনের লক্ষ্য

ইসলামে বছর গণনা করা হয় চান্দ্র মাসের হিসাবে এবং গোটা রমজান মাস একজন মুমিনকে সিয়াম পালন করতে হয়। ফলে বছরের সকল ঋতুতে অর্থাৎ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত বসন্ত পালা করে সিয়াম পালনের মাস রমজানুল মোবারক আসে।

কোনো ঋতুতে প্রচণ্ড গরম পড়ে। আবার কোনো ঋতুতে থাকে হাড় কাঁপানো শীত। মুসলমানগণ বিভিন্ন ঋতুর প্রতিকূল এবং ক্লেশকর পরিস্থিতির মধ্যেই সিয়াম পালন করে থাকেন। তারা এসব করে থাকেন আধ্যাত্মিক সাধনা এবং আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে।

রোজা পালনের আধ্যাত্মিক সুবিধা ছাড়াও জাগতিক বা পার্থিব উপকারিতা রয়েছে। নামাজে যে উপকারগুলো রয়েছে, সিয়াম পালন করেও সেগুলো পাওয়া যায়। সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে আরো পাওয়া যায় স্বাস্থ্যগত সুবিধা। তাছাড়া সিয়াম পালনের মাধ্যমে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটে।

রোজার মূল ও প্রধান উদ্দেশ্য হল ইবাদত। এর লক্ষ্য হল আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে অথবা অন্য কোনো কারণে কেবলমাত্র পার্থিব উদ্দেশ্যে পানাহার করা থেকে বিরত থাকে তাহলে সেটা ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। আধ্যাত্মিকভাবেও সে উপকৃত হবে না।

অসুস্থকালীন সময়ে মহিলারা নামাজের মতো রোজা পালন করা থেকেও অব্যাহতি পেয়ে থাকে। তবে এটুকু ব্যতিক্রম যে, রমজান মাসে একজন মহিলা যে কয়দিনের জন্য রোজা পালন করতে পারছে না, সুস্থ হওয়ার পর তাকে ঠিক সে কয়দিন রোজা পালন করতে হবে। যারা রুগ্ন তাদের জন্যও এই একই বিধান প্রযোজ্য। আবার যে খুব বেশি বৃদ্ধ, সে রোজা পালন করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তবে তার আর্থিক সঙ্গতি থাকলে রমজান মাসের একটি রোজার জন্য তাকে একজন দরিদ্র পানাহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাসূলে কারিম (সা.) লাগাতার কয়েকদিনের জন্য যেমন ৪৮ অথবা ৭২ ঘন্টা রোজা পালন করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নিষেধ করেছেন সারা বছরবা গোটা জীবনব্যাপী রোজা পালন করতে। এমন কি যারা বেশি বেশি আধ্যাত্মিক সাধনা এবং সওয়াবের জন্য অতি উৎসাহী ছিলেন, তাদেরকেও তিনি সারা বছর রোজা রাখতে বারণ করেছেন।

রমজান মাসে সিয়াম পালন করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। ইচ্ছা করলে এর বাইরেও মাঝে মাঝে রোজা পালন করা যায়। তবে সেটা গণ্য হবে অতিরিক্ত এবং নফল ইবাদত হিসাবে। রাসূলে কারিম (সা.) এক সঙ্গে দুদিনের জন্য সিয়ামের অনুমোদন দিয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে সিয়াম পালনের মধ্যে যে সুফল পাওয়া যায়, সিয়াম বা উপবাস নিত্যদিনের স্বভাবে পরিণত হলেও সে ফল পাওয়া যায় না। আবার এক মাসের কম সময় সিয়াম পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। অথচ এক নাগাড়ে ৪০ দিনের বেশি সিয়াম পালন করলে তা নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়।

সমাজে এ রকম একটি ধারণা রয়েছে যে, শীতকালে পানাহার থেকে বিরত থাকলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। বস্তুতপক্ষে এ রকম ধারণার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। জীববিদ্যা সম্বন্ধীয় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, যখন বরফ পড়তে শুরু করে তখন বন্যপ্রাণীরা বাস্তবিক পক্ষে কোনো খাদ্য খাবার সংগ্রহ করতে পারে না।

এ সময়ে তাদের অনাহারে ঘুমিয়ে অথবা অন্য কোনো উপায়ে সময় কাটাতে হয়। অথচ বসন্তে তারা নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে। বৃক্ষরাজির বেলায়ও একথা সত্য। শীতের সময়ে বৃক্ষের পত্র পল্লব পড়ে যায়। এমনকি বৃক্ষরাজিতে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকে না। গাছপালাগুলো যেন এ সময়ে ঘুমিয়ে কাটায়। এভাবে মাস কয়েক উপোস থাকার পর বসন্তের শুরুতে তারা আবার যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। পূর্বাপেক্ষা যেন অধিকতর সতেজ রূপ লাভ করে। এ সময়ে বৃক্ষরাজিকে দেখা যাবে নতুন পত্র পল্লবে বিকশিত ও মুকুলিত অবস্থায়। বস্তুতপক্ষে প্রাণী দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো পরিপাক যন্ত্রেরও বিশ্রাম দরকার। পানাহার থেকে বিরত থাকাই এ ধরনের বিশ্রামের একটি উপযুক্ত মাধ্যম।

পবিত্র কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে যে, ‘কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশগুণ পাবে এবং কেউ কোনো অসৎ কাজকরলে তাকে শুধু তারই প্রতিফল দেওয়া হবে, আর তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। -সূরা আল আনআম: ১৬০

অর্থাৎ একটি ভালো কাজের জন্য আল্লাহতায়ালা দশগুণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিসের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। রাসূল (সা.) বলেছেন যে, যে রমজান মাসে এবং পরবর্তী শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি সিয়াম পালন করবে সে যেন গোটা বছরের জন্য সিয়াম পালন করল। ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৫৫ দিনে একটি চন্দ্র বছর পূর্ণ হয়। এবং মাস গণনা করা হয় ২৯ অথবা ৩০ দিনে। সুতরাং একজন মুমিন-মুসলিম রমজান মাসের অতিরিক্ত আরো ছয়টি রোজা রাখলে মূলত সে বছরে ৩৫ অথবা ৩৬ দিন রোজা পালন করে এবং প্রতিদিনের জন্য দশগুণ হিসাবে সে ৩৫০ দিন অথবা ৩৬০ দিনের সওয়াব পেয়ে যায়।

সুফিয়ায়ে কেরাম লক্ষ্য করেছেন যে, মানব মনের মধ্যে পশু স্বভাবও রয়েছে। এ স্বভাব মানুষের আত্মিক উন্নতির পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। দেহকে আত্মার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হয়। সমৃদ্ধ করতে হয় আত্মিক শক্তিকে। লক্ষ্য করা গেছে যে, দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হলে একদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য ও বিপুল তাড়নাকে পরিহার করতে হয়। অপর দিকে জিহ্বা ও মনের চাহিদা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী।

এভাবে দৈহিক প্রেরণাকে যত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়। মানুষ যখন তার পশু স্বভাবের ওপর আত্মিক ও বিবেকের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে তখনই সে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়। পশু স্বভাব কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আত্মসংযমের মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। সে কারণেই রোজার মতো কঠোর সংযম সাধনার মাধ্যমে সে পশু স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করে।

কেউ যদি কোনো অন্যায় বা পাপকর্ম করে ফেলে তা হলেও সে সিয়াম পালন করে অনুশোচনা করবে ও অনুতপ্ত হবে। সে তার রিপুকে দমন করতে সচেষ্ট হবে। এভাবেই সে প্রশান্তি পাবে। পরিশুদ্ধ হবে তার অন্তর। এমন কি এক পর্যায়ে তার ইচ্ছাশক্তি তার নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।

বস্তুতপক্ষে সমস্ত কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নির্দেশগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করে। এক সময় তাতে সে সফলও হয়। তখন যে আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করে। এভাবেই সে এগিয়ে যায় আল্লাহর সান্নিধ্যে এবং এটাই হলো মানুষের পরম লক্ষ্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘন্টা, জুলাই ১৩, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।