১৭৫০ সাল থেকে শোলাকিয়া মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসাব অনুসারে শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স ২শ’ ৬৬ বছর।
স্থানীয় হয়বতনগর সাহেব বাড়ির শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (রহ.) সে জামাতে ইমামতি করেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী এ শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় দেশের ঈদের জামাত। বৃহত্তম জামাতের হিসাব অনুযায়ী এ বছর এ ঈদগাহ মাঠে ১৮৮তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁ’র ৬ষ্ঠ বংশধর হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান তার মায়ের অসিয়ত মোতাবেক ১৯৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য ৪.৩৫ একর জমি ওয়াক্ফ করেন। সেই ওয়াক্ফ দলিলে উল্লেখ রয়েছে, ১৭৫০ সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিশোরগঞ্জ মৌজার এ মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর। প্রাচীর ঘেরা শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২৬৫টি কাতার রয়েছে যেখানে একসঙ্গে দেড় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। এছাড়া মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঈদগাহ সংলগ্ন খালি জায়গা, রাস্তা এবং নিকটবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে সমসংখ্যক মুসল্লি এ বৃহত্তম ঈদ জামাতে শরিক হন।
শোলাকিয়ার মাঠে ঈদের জামাত শুরু হয় সকাল ১০টায়। এতে ইমামতি করবেন ইসলাহুল মুসলিহীন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ।
ঐতিহ্যবাহী এ মাঠে ইতোপূর্বে যারা ইমামতি করেছেন- হজরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ হজরত উল্লাহ, হজরত মাওলানা পেশওয়ারী, হজরত মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন, আলহাজ মাওলানা হামিদুল হক, হজরত মাওলানা মাজহারুল হক, হজরত মাওলানা আবদুল গনি, হজরত মাওলানা আতহার আলী, হজরত মাওলানা আবদুল মান্নান, হজরত মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মদ নূরুল্লাহ ও মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
শোলাকিয়ার বৃহৎ ঈদ জামাতে নামাজ আদায় করার মানসে প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পাশাপাশি ভিনদেশী মুসল্লিরাও ভীড় করেন।
এ মাঠের রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি শর্টগানের গুলি ছোঁড়া হয়। নামাজ শেষে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালিত হয়। লাখো লাখো আবাল-বৃদ্ধা-বনিতার আমীন, আমীন রবে মুখরিত হয় চারদিক।
দেশের বৃহত্তম এ ঈদ জামাত উপলক্ষে কিশোরগঞ্জ শহরে ঈদ মেলা বসে। মাঠ পার্শ্ববর্তী এলাকায় হস্ত, কারু ও নানারকম শিল্পের মেলা আগত মুসল্লিদের জন্য এক অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। স্থানে স্থানে নির্মিত হয় তোরণ, রাস্তার দু’পাশে টানানো হয় রং-বেরংয়ের পতাকা ও ব্যানার। জামাতের আগে-পরে শহর হয়ে ওঠে লোকে-লোকারণ্য ও উৎসবমুখর। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের তৃষ্ণা লাঘব করতে দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী এবং এলাকাবাসী মুসল্লিদের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি, বাতাসা, মিষ্টান্ন প্রভৃতি বিতরণ করেন।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল শোলাকিয়ার ঈদের নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। এছাড়া অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো গুরুত্বের সঙ্গে এ মাঠের নিউজ কাভার করে থাকে। ফলে শোলাকিয়ার পরিচিতি ও সুনাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক এ ঈদগাহে শত ব্যস্ততা, নানা সমস্যা আর প্রাকৃতিক বৈরিতাকে উপেক্ষা করে সমবেত হন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন ধনী-গরীব নির্বিশেষে। সবার উদ্দেশ্য একটাই- যেন কোনো অবস্থাতেই হাত ছাড়া হয়ে না যায় জামাতে অংশগ্রহণ ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ। ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাম্য ও সুন্দরের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ গড়ার এই শিক্ষা নিয়েই জামাত শেষে বাড়ির পথে শোলকিয়া ছাড়েন তারা।
দূরের মুসল্লিরা ঈদের কয়েকদিন আগেই কিশোরগঞ্জ চলে আসেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজন, আবাসিক হোটেল কিংবা শোলাকিয়ার খোলা মাঠে আগে থেকে অবস্থান নেন।
এ বছরে দূর থেকে আসা মুসল্লিদের যাতায়তের সুবিধার্থে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রুটে দুটি বিশেষ ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ঈদের দিন সকাল ৬টায় ভৈরব থেকে এবং একই সময় ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনগুলো শোলাকিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে। নামাজ শেষে বেলা ১২টায় ভৈরব ও ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ফিরে যাবে বিশেষ ট্রেন দু’টি।
ঈদুল ফিতরের বাকি আর মাত্র দুই দিন। প্রতি বছরের মতো কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে এবারও অনুষ্ঠিত হবে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করেও পুরোদমে চলছে শোলাকিয়া মাঠের শেষ সময়ের প্রস্তুতির কাজ।
ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে ইমামে বসার স্থান (মেহরাব) ও আশপাশের দেয়ালে রঙের কাজ। মেহরাবে করা হয়েছে সাদা, গোলাপি ও নীল রং। বাঁশের তৈরি অবকাঠামোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘন্টা, জুলাই ১৬, ২০১৫
এমএ/