পিরোজপুর: বিচিত্র কারুকাজ ও ক্যালিগ্রাফি সমৃদ্ধ কাঠ দিয়ে তৈরি বিরল মসজিদ পিরোজপুরের ‘কাঠ মসজিদ’। স্থানীয়দের কাছে এ নামে পরিচিত হলেও প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে কাগজে কলমে এটি ‘মমিন মসজিদ’ নামে স্বীকৃত।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মসজিদটি নির্মাণ করেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈল্পিক ভাবনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি মসজিদটি তৈরি করেন। যা শিল্পকর্মের অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার ছেলে পীর বাদশা মিয়ার অনুসারী ছিলেন প্রয়াত মৌলভী মমিন উদ্দিন। অনেক দিন ধরে নিজ বাড়িতে পাকা কাঠ দিয়ে মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন তিনি। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে কাঠের নানা নকশা দেখে নিজেই সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে মসজিদ তৈরির একটি পরিকল্পনা করেন।
১৯১৩ সালে কাঠ মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাঠ শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা থেকে তিনি হরকুমার নাথকে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে মসজিদ তৈরির প্রধান মিস্ত্রি নিয়োগ করেন। ২২ জন মিস্ত্রী দীর্ঘ সাত বছর নিরলস কাজ শেষে ১৯২০ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মমিন উদ্দিন সব সময় মিস্ত্রিদের কাছে থেকে তাদের কাজ পরিচালনা করতেন এবং কারুকাজ গুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মমিন মসজিদ তৈরিতে লোহাকাঠ ও সেগুনকাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। কাঠগুলো মায়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। মসজিদের কাঠামো তৈরিতে লোহার পেরেক ব্যবহার না করে কাঠের শলা ব্যবহার করা হয়। ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থের মসজিদটিতে টিন শেড দিয়ে চৌচালা তৈরি করা হয়। ভিতরে আলো বাতাস প্রবেশ ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য চালের মাঝখানে দ্বিতীয় আর একটি দো-চালা টিন শেড তৈরি করা হয়।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে জানালা রয়েছে। পূর্ব দিকে একটি মাত্র কারুকার্য খচিত দুই খাম্বা বিশিষ্ট দরজা রয়েছে, যাতে শিল্পকর্ম ফুটে উঠেছে। প্রবেশ দ্বারের উপরের বা দিকে আরবি অক্ষরে ইসলামের চার খলিফার নাম ও মাঝখানে হযরত মুহাম্মদ (সা:) নাম অলংকৃত করা হয়েছে। প্রবেশ দ্বারের মাঝখানের অংশে লেখা রয়েছে লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
লেখার ক্ষেত্রে দেওয়ানি ও জালি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। (দেওয়ানি পদ্ধতি পার্সিয়ানি তালিক পদ্ধতির বিবর্তিত রূপ। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। জালি পদ্ধতি দেওয়ানির আর একটি পরিবর্তিত রূপ। হাফিজ ওসমান এটির প্রচলন শুরু করেন)। এ মসজিদে কাঠ শিল্পে জ্যামিতির ব্যবহার এবং কাঠের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফি সবাইকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পুরাকীর্তি আইন অনুযায়ী মমিন মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ২০০৮ সালে খুলনা জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়নে মমিন মসজিদ প্রথম বারের মত সংস্কার করা হয়। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৩০টি শিল্প সমৃদ্ধ মসজিদের তালিকায় রয়েছে এ মসজিদ। ২০১৩ সালে ০৪ ফেব্রুয়ারি মমিন মসজিদ শতবর্ষে পা দেয়। এ উপলক্ষে মসজিদ প্রাঙ্গণে আলোচন সভার আয়োজন করে পিরোজপুর জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করে বলেন, ২০০৮ সালে সংস্কারের সময় লোহার ব্যবহারসহ নকশার কিছু পরিবর্তন আনা হয় হয়। উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করায় মসজিদের রুপে পরিবর্তন আসে। বর্তমানে মসজিদটিতে উঁই পোকা আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মমিন মসজিদকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক আমিরুজ্জামান জানান, মহাপরিচালকের নির্দেশে গঠিত কারিগরি কমিটি শীঘ্রই মসজিদটি পরিদর্শন করে সুপারিশ করবেন। সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মমিন উদ্দিন আকনের নাতি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, শত বছর আগে মমিন মসজিদ তৈরিতে মমিন উদ্দিন যে শিল্প রুচির পরিচয় দিয়েছে তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। সরকারের সহায়তা ও প্রচার পেলে এ মসজিদ পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনায় পরিণত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৫
এমজেড/