অতি সামান্য ও তুচ্ছ কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে নৃশংস ও গা শিউরে উঠার মতো সব হত্যাকাণ্ড। পরিসংখ্যান দিয়ে এর ভয়াবহতা বুঝানোর দরকার নেই।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি। যে জাহেলি যুগে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি, হানাহানি এবং রক্তের বদলে রক্ত নিতে গিয়ে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের জীবনহানি ঘটত এবং বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহ চলত!
ইসলামের মহান প্রবর্তক বিশ্বশান্তির মূর্ত প্রতীক হজরত মুহাম্মদ (সা.) এসে এ সবকিছু সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে ঘোষণা করলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। ’ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে কারিমে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। ’ -সূরা আল মায়েদা: ৩২
ইসলাম সব ধরনের অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, জুলুম নির্যাতনে বিরুদ্ধে। সে হিসেব বলা চলে, সত্যিকারের কোনো মুসলিম সমাজের অশান্তি হয় এমন কাজ করতে পারে না।
অন্যায়ভাবে হত্যার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিশাপ করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন। ’ -সূরা আন নিসা: ৯৩
ইসলাম কোনোভাবেই অন্যের জানমালের ক্ষতিসাধন সমর্থন করে না। যারা মানুষের জানমালের ক্ষতি করে ইসলাম তাদের প্রকৃত মুমিন বলে স্বীকৃতি দেয় না। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মুমিন সে ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। ’
সুতরাং একজন সত্যিকারের মুসলমান কখনো অন্য মুসলমানের জানমালের ক্ষতি করতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গণপিটুনি দিয়ে যেভাবে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত করা হচ্ছে- এসব ইসলাম সমর্থন করে না। বস্তুত কোনো বিবেকবান মানুষও এমন হত্যা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সমর্থন করতে পারে না।
যেহেতু বিষয়গুলো আইন, ধর্ম ও মানবিকতা পরিপন্থী, তাই আমরা মনে করি- সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হস্তে দেশের যে কোনো স্থানে সংঘটিত নৃশংস ঘটনা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই হঠাৎ করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কেন বেড়ে গেছে, কি কারণে ঘটছে- তার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বিশেষ করে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ড কি কারণে বেড়ে গেছে এবং কারা করছে তার গভীর অনুসন্ধান করা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। অবশ্য অনেক সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত ইতোমধ্যে কোনো কোনো পত্রিকায় উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এর পেছনের অন্যতম কারণ। তেমনি এর পেছনে রয়েছে সামষ্টিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও।
এছাড়া চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রযুক্তির প্রতি অনিয়ন্ত্রিত মনোনিবেশ, ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, নৈতিক অবক্ষয়, প্রতিহিংসা, মাদকের প্রভাবসহ আরও অনেক কারণ রয়েছে নৃশংসতার নেপথ্যে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বোপরি ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা ও ধর্মীয় নীতি নৈতিকতার বিকাশে বিভিন্ন বাধার কারণে সমাজে নৈতিকতা লোপ পাচ্ছে, হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। তার প্রভাবে সমাজের একটি শ্রেণি বেপরোয়া হয়ে ঊঠেছে। যাদের দ্বারা ঘটে চলেছে এসব গণপিটুনি, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও পৈশাচিক খুন-রাহাজানি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না, চলতে দেয়া যায় না।
সুতরাং দেশ ও সমাজকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে হবে। এক কথায় প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সুস্থ ধারার সমাজ। আর তখনই সম্ভব একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। সেই নিরাপদবোধ করবে সাধারণ মানুষ। আমরা সেদিনের অপেক্ষায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫১ ঘন্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৫
এমএ/