মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। শুধু সাংবাদিকতা নয়, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী।
আমাদের গর্ব মওলানা আকরম খাঁ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৯ সালের ৯ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার হাকিমপুর গ্রামে। কম বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে নানার কাছে প্রতিপালিত হন তিনি। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরাগবশত ইংরেজি স্কুল ত্যাগ করে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেটা ১৮৯৬ সালের কথা। ১৯০১ সালে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেন আকরম খাঁ।
সে সময় মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ, সমস্যার কথা বলার তেমন সুযোগ ছিলো না। ছাত্রজীবন থেকেই এ ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতেন আকরম খাঁ। এ কারণে তিনি মাদ্রাসার পড়া শেষ করার পরপরই ১৯০১ সালে সাংবাদিকতায় যোগ দেন।
তখন আবদুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১৯১০ সালে এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন আকরম খাঁ। ১৯১৩ সালে গঠিত হয় আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলা নামে একটি সংগঠন। আকরম খাঁ মনোনীত হন এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। ১৯১৪ সালে এখান থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘আল ইসলাম’-এর যুগ্ম সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালে সংঘটিত খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন আকরম খাঁ। ‘দৈনিক যমানা’ নামে একটি পত্রিকা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। এটি ছিলো উর্দু পত্রিকা। একই বছর একই সঙ্গে দৈনিক সেবক এবং সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ‘অগ্রসর’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশের কারণে ১৯২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আকরম খাঁ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯২২ সালে।
১৯২৭ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীকে আরো রুচিশীল করে প্রকাশের জন্য মাসিক মোহাম্মদী নামে প্রকাশ করেন।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর দৈনিক আজাদ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনায় হাত দেন আকরম খাঁ। তিনিই ছিলেন দৈনিক আজাদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার সাংবাদিক জীবনের অমরকীর্তি ‘দৈনিক আজাদ’ প্রকাশ ও সম্পাদনা। অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ও ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষায় ‘আজাদ’ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ চিন্তা তার মন মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দেশবাসীর সার্বিক কল্যাণের জন্য তিনি স্বাধীনতাকে প্রথম ও প্রধান শর্ত বিবেচনা করেছিলেন। তিনি তার প্রকাশিত পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন।
বলা হয়ে থাকে যে, মওলানা আকরম খাঁ ও তার আজাদ পত্রিকা না থাকলে পূর্ববাংলা পাকিস্তান হতো না আর পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না।
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক পরিচিতি ছাড়াও মওলানা আকরম খাঁর আরেকটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে- তা হলো তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। মুসলিম বাংলার জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে তার সাহিত্য সাধনা মূল্যবান ভূমিকা রাখে। আরবি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপন্ন আকরম খাঁ বাংলায় রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ চিন্তামূলক গ্রন্থ রচনায় পারদর্শিতার পরিচয় দেন। বাংলা সাহিত্যে তার অক্ষয় কীর্তি হজরত মোহাম্মদ (দ.)-এর জীবনী ‘মোস্তফাচরিত’ এবং পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদ ‘তফসিরুল কোরআন’।
‘সমস্যা ও সমাধান’ তার লেখা একটি গবেষণা গ্রন্থ। এ গ্রন্থে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ, ব্যাংকিং, সঙ্গীত ইত্যাদি নানা সমস্যামূলক আলোচনা ও তার সমাধান রয়েছে। ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’, ‘মুক্তি ও ইসলাম’ তার রচিত অন্যান্য গদ্য গ্রন্থ।
প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ মওলানা আকরম খাঁ সম্বন্ধে বলেছেন, ‘মওলানা আকরম খাঁ সাহেব বহু বিষয়ে আমাদের বাঙালি মুছলিম সমাজের অগ্রপথিক। ... কাগজে ছবি ছাপান জায়েজ কি না-জায়েজ, এ নিয়ে যখন আমাদের আলেম সমাজে তুমুল তর্ক চলছিল, তখন তিনি ‘সমস্যা ও সমাধান’ লিখে এ তর্কের সমাধান করেন। বাংলার মুসলমানরা আরবী ও ফারসী ভাষার যেসব শব্দ তাদের কথায় হামেশা ব্যবহার করে থাকেন, সেই সব শব্দকে সাহিত্যে স্থান দেওয়ার জন্য মওলানা সাহেব যে প্রচার করেন, তা নিস্ফল হয় নাই। ... এ দেশে বহু বিষয়ে মওলানা আকরম খাঁ একক। ’
১৯৪৮ সালে আকরম খাঁ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৬৩ সালে রাজনীতি থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
দেশবরেণ্য এ মনীষী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘন্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫
এমএ/