চলতি বৃষ্টির মৌসুমেও দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে অনেক পরিবার। নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে কৃষিজমি, আবাসন গৃহ, বৃক্ষ-বাগান ও স্থাপনা।
চলতি বর্ষায় নদী ভাঙনে সবচেয়ে দুরবস্থায় রয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। রাতেও যাদের ঘর, ফসলি জমি ছিল ভাঙনে সকালে তারা গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা হলো, নদী ভাঙন এ দেশের নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নদী ভাঙনের নেতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য। নদীভাঙন রোধে নানা সময়ে নানা কর্মসূচি সময়ে-অসময়ে নেওয়া হলেও নদী ভাঙন বন্ধ হয়নি। তাই এবার নদ-নদী রক্ষা এবং নদীর ভাঙন ঠেকাতে পদ্মার পাড়ের মানুষ ধর্মবিশ্বাসের আশ্রয় নিলেন। পদ্মার ভাঙনরোধে এলাকাবাসী কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লেখা বিশেষ বড়ি নদীতে নিক্ষেপ করলেন।
পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার জগৎদিয়া গ্রামের সাহেব আলী মণ্ডল (৯৮) নদী ভাঙনরোধে ধর্মীয় বিশ্বাসে কাগজে লেখা আরবি হরফে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ছাপিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে সোয়া লাখ আটার গুলিতে ভরে নদীতে নিক্ষেপ করেছেন।
গত সোমবার বিকেল থেকে এলাকার সর্বস্তরের শত শত মানুষের সহযোগিতায় ভাঙনকবলিত এলাকায় কালেমা লেখা কাগজ আটার কাঁইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে বড়ি বানিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। আজ থেকে ১২ বছর আগে একইভাবে কালেমা লেখা কাগজ নদীতে ফেলে ভাঙনরোধ করেছিলেন বলে দাবি করেন সাহেব আলী মণ্ডল।
খবরে প্রকাশ, পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ফেরিঘাট থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার ভাটির ধুতরাবাড়ী, নয়াকান্দি, মান্দাখোলা, কাইজারটেক ও মালুচী এলাকা পর্যন্ত নদীভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনরোধে ধর্মীয় বিশ্বাসে সাহেব আলী কালেমা লেখা কাগজ এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে এই বিশেষ কবজ ফেলেছেন।
সাহেব আলী দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকে তাকে সাহেব আলী মোল্লা বলে ডাকেন। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি তার রয়েছে অগাধ বিশ্বাস। এলাকায় তিনি ভালো মানুষ বলে পরিচিত।
১২ বছর আগে যখন এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছিল, তখন তিনি দুই মণ আটা দিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে তাতে কালেমা লেখা কাগজ ভরে এলাকাবাসীকে নিয়ে নদীতে ফেলেছিলেন। তখন নদীভাঙন রোধ হয়েছিল। পরের বছরও এভাবে বড়ি ফেলায় এলাকায় চর জেগে উঠেছিল। এ বছর ভাঙন শুরু হওয়ায় আবার তিনি কালেমা লেখা কাগজ নদীতে ফেললেন।
সাহেব আলী এ বছর সাত মণ আটার মণ্ড তৈরি করেছেন। এলাকার জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন। প্রেস থেকে আরবি হরফে কালেমা লেখা কাগজ ছাপিয়ে ছোট ছোট করে সোয়া লাখ টুকরো করা হয়। এর পর পাক-পবিত্র হয়ে কালেমা পড়তে পড়তে একেকটা কাগজের টুকরা আটার মণ্ডে ভরে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করা হয়। বেড়ি তৈরি শেষে সেগুলো নদীর পাড় হেঁটে কালেমা পড়তে পড়তে নিক্ষেপ করা হয় নদীতে।
এ বিষয়ে এলাকাবাসীর অভিমত হলো, ‘সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। যেহেতু আল্লাহর কালাম নদীতে ফেলা হচ্ছে, সেহেতু আল্লাহর মেহেরবাণীতে ভাঙনরোধ হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। ’
ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসের পক্ষে আরও যুক্তি হলো, বিভিন্ন পীর-আউলিয়া ও বুজুর্গদের জীবনী। তাদের জীবনীতে পাওয়া যায়, নদীভাঙনরোধ করতে বিভিন্ন সময় তারা এমন আমল করেছেন।
যেহেতু এই আমলের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিধানের সাংঘর্ষিক কোনো বিধান নেই, এটা নিছক বিশ্বাসের অালোকে করা হচ্ছে তাই তাতে শরিয়তও বাধা দেয় না- এমনটাই দাবী ইসলামি স্কলারদের।
বস্তুত ধর্মবিশ্বাস মানুষের চিরায়ত বিষয়। এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ কষ্ট করে হলেও ধর্মীয় বিধি-বিধান, রীতি-নীতি পালন করে থাকেন। ধার্মিক মানুষের কাছে ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মশাস্ত্র শেষ অবলম্বন। সাহেব আলীর মতো হাজারো নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের এই প্রচেষ্টা, আল্লাহর রহমত কামনার নিরন্তর আঁকুতি এটাই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘন্টা, ২৬ আগস্ট, ২০১৫
এমএ