ইসলামে তিনটি যুগকে শ্রেষ্ঠ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ তিনটি যুগ সম্পর্কে বলেছেন, আমার যুগ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, অতঃপর পরবর্তী যুগ, এরপর তৎপরবর্তী যুগ।
এক. রাসূলের যুগ, দুই. সাহাবি ও তাবিঈদের যুগ, তিন. তাবে-তাবিঈদের যুগ। সৌভাগ্যক্রমে এ যুগগুলোতেই বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে।
ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম
ঠিক কখন বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিল তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে এতদসম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের পরিবেশিত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হিজরি প্রথম শতকেই ভারতীয় উপমহাদেশে তথা মালাবারে ইসলামের আগমন ঘটে এবং বাংলায় ইসলাম আগমনের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় চট্টগ্রাম অঞ্চল।
এখানেও একটি জটিলতা রয়েছে। সেটা হলো, বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকা চট্টগ্রামে কখন ইসলামের আগমন ঘটেছিল তা সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা দুরূহ। তবে অনুমানের ভিত্তি ও বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ এবং তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে এটা বলা যায়, খ্রিস্টাব্দ অষ্টম অথবা নবম শতকে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবের মুসলমান বণিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আর সেই সূত্র ধরে বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিমের উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘খ্রিস্টীয় অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনাগোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিকরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। চট্টগ্রামী লোকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন, আলকরণ, সুলুকবহর, বাকলিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করে। ’
ড. আবদুল করিমের এই বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রাম দিয়েই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। এ কারণে চট্টগ্রামকে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। সুতরাং যে কোনো সূত্র বা পর্যায়েরই হোক চট্টগ্রামের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে সবার কাছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শীর্ষ নিউজপোর্টাল বাংলানিউজের পাঁচ বছর পূর্তির বিশেষ অনুষ্ঠান হলো বীর প্রসবিণী চট্টগ্রামে। এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে আমারও সুযোগ হয় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার। এর আগে চট্টগ্রামে অনেকবার গেলেও মূল শহরে থাকা হয়নি। আশেপাশের জেলা শহর ঘুরা হয়েছে। যেহেতু চট্টগ্রাম যাচ্ছি তাই পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে রাখি বেশ কয়েক জায়গায় যাওয়ার। ওইসব জায়গার আলাদা আলাদা গল্প হবে। আজ শুধু চট্টগ্রামে ইসলামের আগমন পর্ব নিয়ে আলোচনা।
বারো আউলিয়ার দেশ নাম কেন?
চট্টগ্রামের আরেক নাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ। ’ ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ কথাটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুটি স্থানে বারো আউলিয়ার সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। এর একটি হলো সীতাকুন্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে অবস্থিত পীর বারো আউলিয়ার মাজার।
গ্রামের নাম সোনাইছড়ি হলেও সীতাকুন্ড উপজেলার এ এলাকাটি বারো আউলিয়ার মাজার নামে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। যদিও এখানে বারো আউলিয়ার অন্তর্গত কোনো পীরের মাজার নেই। তবে এ স্থানটি বারো আউলিয়ার আস্তানা, খানকা বা সম্মিলনস্হল ছিল বলে জানা যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সুদূর আরব, ইরাক, ইরান বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য সুফি সাধকরা এখানে আগমন করতেন। তারা এখানে বসে সমবেতভাবে পরামর্শ করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। সে মোতাবেক দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তেন। এসব পীর আউলিয়াদের কেউ কেউ অনেক সময় এখানে অবস্থান করে নির্জনে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন। ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ জায়গাটি বারো আউলিয়ার মাজার, দরগা বা আস্তানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
এ ছাড়া শহর থেকে প্রায় ৯-১০ কিলোমিটার দূরে বর্তমান চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বালুছড়া নামক স্থানে বারো আউলিয়ার নামে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটা জামে মসজিদ রয়েছে।
ড. গোলাম সাকলায়েন লিখিত ‘বাংলাদেশের সূফী-সাধক’ গ্রন্থের ১২৯-১৩০ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রামের ‘বারো আউলিয়ার’ মধ্যে দশ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন-
১. হজরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)।
২. হজরত শেখ ফরিদ (রহ.)।
৩. হজরত বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহ.)।
৪. হজরত কতল পীর (পীর কতল) (রহ.)।
৫. হজরত শাহ্ মহসিন আউলিয়া (রহ.)।
৬. হজরত শাহ্ পীর (রহ.)।
৭. হজরত শাহ্ উমর (রহ.)।
৮. হজরত শাহ্ বাদল (রহ.)।
৯. হজরত শাহ্ চাঁদ আউলিয়া (রহ.)।
১০. হজরত শাহ্ জায়েদ (রহ.)।
উল্লেখিত ইসলাম প্রচারকদের সবাই কিন্তু মূল চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের কাজ করেননি। তারা চট্টগ্রামের আশেপাশে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
অলৌকিক চেরাগের আলোয় আলোকিত চট্টগ্রাম
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে, শুধু হজরত বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহ.) চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত হন। তিনি যখন এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন, তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল জনমানবহীন গভীর পাহাড় পর্বতে ঘেরা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তখন এ এলাকায় জ্বীন-পরীদের বাসস্থান ছিল। হজরত বদর শাহ (রহ.) একটি মাটির চেরাগ হাতে নিয়ে গভীর বন-জঙ্গল দিয়ে একটি পাহাড়ের উপর উঠলে জ্বীন-পরীরা তাকে বাধা দেয় এবং বলে, তাদের আবাসস্থলে কোনো মানুষের স্থান নেই।
রাতের অন্ধকার নেমে এলে হজরত বদর শাহ (রহ.) জ্বীন-পরীদের কাছে শুধু চেরাগ রাখার স্থানটুকু চাইলে তারা সম্মতি জ্ঞাপন করে। তিনি চেরাগ জ্বেলে দিলে তা থেকে তীব্র তেজ বিকিরণ করতে থাকলে জ্বীন-পরীদের শরীরে প্রকট জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং আস্তে আস্তে এখানে মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। এভাবেই চেরাগ রাখার পাহাড় চেরাগী পাহাড় নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতীকী অর্থে এখান থেকে চেরাগ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিল চট্টগ্রাম এবং সেই থেকে আজ অবধি চট্টগ্রাম আলোকিত হয়ে উঠছে ক্রমাগত। কিংবদন্তি আছে যে, ওই চেরাগটি ছিল অলৌকিক।
বর্তমানে চেরাগির মোড়ে স্থাপিত মনুমেন্টটি ইতিহাসের স্মারক। এই চেরাগ যেন মূল্যবোধের প্রতীক। যে চেরাগ মনুমেন্ট চট্টগ্রামবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের গর্বিত ইতিহাসের কথা। এই চেরাগ জ্বালিয়ে আলোকিত করা হয়েছিল চট্টগ্রাম, দূর করা হয়েছিল তাবৎ অশুভ শক্তিকে। ইতিহাসের সুন্দরতম অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এই চেরাগের আলো ধরে।
তাই তো আমরা দেখি, চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও মাজার। এই চট্টগ্রামের মাটি জন্ম দিয়েছে হাজারো আউলিয়া। যে ধারাবাহিকতা এখনও চলমান।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৫
এমএ