মানবাধিকার একটি বহুল পরিচিত শব্দ। তবে মানবাধিকার বলতে আসলে কি বোঝায়, এর বাস্তব ধারণা অনেকটাই দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ।
এমনই বাস্তবতায় বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে- ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’।
সব মানুষের জন্মগত অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়ার সব মানুষের সব ধরনের মানবাধিকার ভোগ করার অধিকার রয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ, কাল, পাত্র নির্বিশেষে এটি একটি বৈষম্যহীন অধিকার।
মানব সভ্যতার শুরু থেকে মানবাধিকারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও মৌলিক মানবাধিকার কিন্তু সব সময় একই ছিল। যেমন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার সকল যুগে স্বীকৃত। আল্লাহতায়ালা এ অধিকার শুধু মানুষ নয় সব প্রাণীর জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
ইসলামে মানবাধিকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়। মানবাধিকারের বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বত্র সমান। মানবজাতিকে ইসলাম গৌরব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম মানুষকে সমান অধিকার, একতা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। ইসলামে বংশ মর্যাদা, শ্রেণীবিভেদ, জাতিগত বিভেদ ও বর্ণবিভেদ হতে সতর্ক করেছে। দাস-দাসী ও অধীনস্তদের প্রতি সুন্দর ও ন্যায়ানুগ ব্যবহার করতে শিক্ষা দিয়েছে।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষ হিসেবে সবাই সমান মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। মৌলিক অধিকার সবার সমান। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারও সবার ক্ষেত্রে সমান। ব্যক্তি স্বাধীনতাও সবার ক্ষেত্রে সমান। মর্যাদার দিক দিয়ে ইসলামে ধনী গরিব সবাই সমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও সবার ক্ষেত্রে এক। জানমালের নিরাপত্তার অধিকার একই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা সবার ক্ষেত্রে এক। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইসলামে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সৎ পথে উপার্জন করার অধিকারও ইসলামে সবার জন্য সমান। অসহায়, প্রতিবন্ধী, এতিম, মিসকিন, নারী ও শিশু অধিকার ইসলাম সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে আর নিজে পেট পুরে খায় সে ব্যক্তি মুমিন নয়। কৃষক, মজুর, শ্রমিকের অধিকারও মূল্যায়িত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই মজুরি পরিশোধের তাকিদ দিয়েছে ইসলাম।
সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহতায়ালার নির্দেশে মানবাধিকারের এ সব স্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজে নবী মুহাম্মদ (সা.) যে অবিস্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল মানবাধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি দলিল। তিনি ওই দিন ভাষণে বলেছিলেন, ‘হে মানব সকল! অবশ্যই তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতাও একজন। সুতরাং আজ থেকে কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের প্রাধান্য নেই। সাদা মানুষের ওপর কালো মানুষের এবং কালো মানুষের ওপর সাদা মানুষের কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একমাত্র আল্লাহভীতি ও মানব কল্যাণ হলো মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড। ’
তারপর তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মনে রেখো! প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, সবাই একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কেউ কারো থেকে ছোট নয়, কারো থেকে কেউ বড়ও নয়। মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সবাই সমান। নারী জাতির প্রতি অবহেলা করো না। নারীর ওপর পুরুষের যে ধরনের অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের ওপর সে ধরনের অধিকার আছে। তাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার করো না। মনে রেখো! মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছ। সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ইতঃপূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ’
লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে, ইসলাম সর্বপ্রথম মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। সেই সঙ্গে সব মানুষের সৎ পথে সম্পদ অর্জন এবং বৈধ পথে তা ভোগ করার অধিকার দিয়েছে। মানুষের মান-সম্মান রক্ষার জন্য ইসলাম নানা নিয়ম-নীতি প্রদান করেছে। এ কারণে ইসলাম পরনিন্দা, জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা অপবাদ, কুৎসা রটনা ইত্যাদিকে হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার প্রতি ইসলাম কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইসলাম সব মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দান করেছে। নারী-পুরুষ উভয়ের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার দিয়েছে। স্বামী যা উপার্জন করবে, তা স্বামীর অধিকারে থাকবে আবার স্ত্রী যা কিছু উপার্জন করবে, তা স্ত্রীর অধিকারে থাকবে। ইসলামী বিধান অনুযায়ী নারীরাও পুরুষদের মতো সম্পদের মালিক হবে। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেও নারীরা তাদের মৃত পিতা-মাতা, স্বামী ও সন্তানদের একটি নির্দিষ্ট অংশ আলাদাভাবে ভোগ-দখল করতে পারবে। এমনকি ইসলাম ধনীদের সম্পদে অসহায় ও মিসকিনদের অধিকারের বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে।
এক কথায় বলা চলে, ইসলাম মানুষের যাবতীয় অধিকার রক্ষায় নির্দেশনা দিয়েছে। যে সত্যিকারের মুমিন-মুসলমান তার মাধ্যমে কখনো মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘন হতে পারে না। এটাই ইসলামের দাবী।
সে হিসেবে বলা যায়, সমাজে যখন ইসলামের শান্তিপূর্ণ বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপূর্ণরূপে পালিত হবে এবং সামগ্রিকভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, তখন মানুষ আর অধিকারবঞ্চিত থাকবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
এমএ/