১২ রবিউল আউয়াল। ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন হিসাব মতে, বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী রাহমাতুল্লিল আলামিন সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুন্নাবিয়ীন তাজদারে মদিনা জগতকুল শিরোমণি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ওফাত দিবস।
শুক্রবার মহিমান্বিত সেই দিন, মুসলমানদের স্বমহিমায় জেগে উঠার দিন।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ১২ রবিউল আউয়ালকে বিভিন্নভাবে উদযাপন করে থাকেন। কেউ কেউ এ উপলক্ষে জমায়েত হয়ে নবীজীর জন্মের ঘটনা আলোচনা করেন এবং বক্তৃতা ও কাসিদা পড়েন। কেউবা মিষ্টি-খাবার প্রভৃতি তৈরি করে বিতরণ করেন। কেউ কেউ মসজিদে তা উদযাপন করেন, কেউ বা উদযাপন করেন বাড়িতে।
১২ রবিউল আউয়াল উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনের ওপর আলোচনা, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগে।
দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। আজ সংবাদপত্রসমূহে ছুটি পালিত হবে। তাই আগামীকাল শনিবার দৈনিক পত্রিকাসমূহ প্রকাশিত হবে না।
দিবসটি উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও।
আজ থেকে ১৪শ’ ৪৫ বছর পূর্বে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়ালের সুবহে সাদেকের সময় মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশে মা আমেনার গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পূর্বেই তিনি পিতৃহারা হন এবং জন্মের অল্পকাল পরই বঞ্চিত হন মাতৃস্নেহ থেকেও। অনেক দুঃখ, কষ্ট ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেন। চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর তিনি সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নবুওয়তের মহান দায়িত্ব লাভ করেন। নবু্ওয়ত পেয়ে অসভ্য বর্বর ও পথহারা জাতিকে সত্যের সংবাদ দিতে তিনি তাদের কাছে তুলে ধরেন মহান রাব্বুল আলামীনের তাওহিদের বাণী। কিন্তু অসভ্য মূর্খ জাতি তার দাওয়াত গ্রহণ না করে রাসূলের ওপর নির্যাতন শুরু করে, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্নমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে একের পর এক। কিন্তু তিনি আল্লাহতায়ালার সাহায্যের ওপর ভরসা করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। ধীরে ধীরে সত্যান্বেষী মানুষ তার সঙ্গি হতে থাকে।
অন্যদিকে মক্কার কাফেরদের ষড়যন্ত্র প্রবল আকার ধারণ করে। এমন এক পর্যায়ে তারা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করেন এবং মদিনা সনদ নামে একটি লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন। মদিনা সনদ বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান নামে খ্যাত। এ সংবিধানে ইহুদি খ্রিস্টান ও মুসলমানসহ সকলের অধিকার স্বীকৃত হয় যথার্থভাবে।
নবীর এই সাফল্যে মক্কার কাফেরদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয় লেবাসধারী মুনাফিকচক্র। এরা ইসলামের চরম ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়। তা সত্ত্বেও ইসলামের অগ্রযাত্রা চলতে থাকে দ্রুততার সঙ্গে। এভাবে দীর্ঘ ২৩ বছর শ্রম সাধনায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিজয় অর্জন করেন। আর মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে।
অতঃপর বিদায় হজের ভাষণে তিনি আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন মানবজাতিকে। বলেছেন, ‘আজ থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। তোমাদের জন্য দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে একমাত্র ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে। ’
বস্তুত রাসূলের রেখে যাওয়া সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার আদর্শ থেকে মুসলমানরা বিমুখ হওয়ায় বর্তমান বিশ্বে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ইসলাম বিরোধীদের হাতে আজ বিশ্বের সর্বত্র মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। অন্যায়, অবিচার আর বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই অশান্ত এই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে যারা রাসূলের রেখে যাওয়া আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাদের পথও কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কাফের ও ইসলামের লেবাসধারী মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। কাফেরদের পাশাপাশি ধর্মের লেবাসধারীরাও ইসলামকে কলঙ্কিত করতে চায়। তবে তারা কখনও সফল হবে না। কারণ, পূর্বেও কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র রাসূলের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারেনি, আজও পারবে না। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত। আর নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্তির জন্য। ’ সুতরাং সত্যের সংগ্রামে সাফল্য অনিবার্য।
মুসলিম উম্মাহ এখন শত সহস্র সমস্যায় জর্জরিত। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে মুক্তির পথে আহবান জানানোর দায়িত্ব দিয়েছেন যে শ্রেষ্ঠ উম্মতকে তারা এখন অন্যান্য জাতির অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি ফিরে যেতে হবে। তাহলে মুসলিম উম্মাহ আবার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। মানবতা খুঁজে পাবে শান্তি ও মুক্তির পথ। বস্তুত ১২ রবিউল আউয়াল মুসলিম উম্মাহর আপন শক্তিতে জেগে উঠার দিন, স্বমহিমায় ফিরে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিন।
প্রসঙ্গত বলতে হয়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির জন্য এক উজ্জ্বল অনুসরণীয় আদর্শ। নিজ যোগ্যতা, সততা, মহানুভবতা, সহনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম, আত্মপ্রত্যয়, অসীম সাহস, ধৈর্য, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, নিষ্ঠা, অপিরসীম দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে তার ওপর অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমের বাণী তথা তাওহিদ প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগ দূর করে অত্যাচার ও নির্যাতন বরণ করে সত্য ও ন্যায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের সেবা, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, পরমত সহিষ্ণুতা, দয়া ও ক্ষমাগুণ, শিশুদের প্রতি দায়িত্ব এবং নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অতুলনীয় এবং তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে অভিষিক্ত।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আজকের দিনে আমরা যদি নবী সেই আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণ করি, তবে সফলতা অনিবার্য।
১২ রবিউল আউয়াল উপলক্ষ্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি জানাই ভালোবাসাদীপ্ত অসংখ্য দরূদ ও সালাম। ইয়া নবী সালামু আলাইকা, ইয়া রাসূল সালামু আলাইকা। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করি, জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসূলের অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করার। এটাই হোক এবারের ১২ রবিউল আউয়ালের শপথ। আল্লাহতায়ালা আমাদের কবুল করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৫
এমএ/