দীর্ঘ নয় মাস দশ দিন নিজের ভেতরে ধারণ করে, নিজের রক্ত দিয়ে লালন করে, অবর্ণনীয় এক কষ্টের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুন্দর সুযোগ যিনি করে দেন- তিনিই মা। গর্ভধারণ, প্রসব ও স্তন্যদান এ তিনটি কাজ করতে যেয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মায়েরা যে কষ্ট করে থাকেন; তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন কাজ।
যে সন্তান জন্ম থেকে পঙ্গু, পাগল, দৈহিক অক্ষম। ভবিষ্যতে ওই সন্তান মায়ের কোনো উপকারে আসবে না, বরং মায়ের ভোগান্তি বাড়াবে। একজন মা তার এমন সন্তানকেও ভালোবাসেন। মাতৃত্বের মন উজাড় করা মমতা দিয়ে সন্তানের যত্ন নেন। এটাই মায়েদের চরিত্র ও অভ্যাস।
মাকে কষ্ট দেওয়া, মায়ের অবাধ্য হওয়া দ্বিতীয় বড় অপরাধ। প্রথম বড় অপরাধ হলো- আল্লাহতায়ালার সঙ্গে কাউকে শরিক করা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। ’ –সহিহ মুসলিম: ৪৫৮০
মহান আল্লাহতায়ালা নিজের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন মাতা-পিতার অধিকারের কথা। পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। তাদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলো। ’ –সূরা বনি ইসরাঈল: ২৩
একলোক এসে মহানবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার থেকে সদাচরণ পাওয়ার সর্বাধিক অধিকার কার? তিনি উত্তরে বললেন, তোমার মা। সে আবারও একই প্রশ্ন করলো। তিনি দ্বিতীয়বারও উত্তরে বললেন, তোমার মা। সে আবারও একই প্রশ্ন করলে তিনি তৃতীয়বারের উত্তরে বললেন, তোমার মা। সে আবারও একই প্রশ্ন করলে নবী করিম (সা.) চতুর্থবারে বললেন, তোমার পিতা। ’ –সহিহ বোখারি: ৫৯৭১
মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে সাধারণত সন্তানের সেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সন্তানেরও উচিৎ এ সময় মায়ের সুবিধা-অসুবিধা ও প্রয়োজনের প্রতি বেশি যত্নশীল ও দায়িত্বশীল হওয়া। একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা!’ উপস্থিত সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, সে কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মাতা-পিতা উভয়কে অথবা যে কোনো একজনকে বৃদ্ধ পেয়েও (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। ’ –সহিহ মুসলিম: ৬৬৭৫
মায়ের সেবা করা, মায়ের যত্ন নেওয়া এবং মাকে খুশি করার গুরুত্ব বুঝাতে যেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, জান্নাত মায়ের পদতলে। -কানজুল উম্মাল: ৪৫৪৩৯
ক্যারিয়ার বিলাসিতার এ যুগে মায়েরা বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছে। ক্যারিয়ারের মিছে মোহ সন্তানের সেবা-যত্ন থেকে মাকে বঞ্চিত করছে। বৃদ্ধ অসহায় মা তার কলজে ছেঁড়া সন্তানের প্রিয় মুখখানি একনজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন। দরজার দিকে তাকিয়ে সন্তানের অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলতে থাকেন। কিন্তু মাকে দেওয়ার মতো সময় সন্তানের জীবনে হয়ে ওঠে না। এটা বড় নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মম, অমানবিক আচরণ। যে মা রাতের পর রাত জেগে সন্তানকে মানুষ করেছেন, আজ ওই মায়ের পাশে বসার মতো সময় সন্তানের হাতে নেই, মায়ের সেবা-যত্ন করার মতো সময় নেই। বলি, কী হবে এ ক্যারিয়ার দিয়ে? কি হবে ধন-সম্পদের এ পাহাড় দিয়ে?
মাকে দূরে সরিয়ে রেখে, নিজের পরিবার থেকে বাইরে রেখে শুধুমাত্র বছরের নির্দিষ্ট দিনে একটি ফুলের তোড়া আর শুভেচ্ছা বার্তা ও কিছু উপহার পাঠিয়ে মায়ের অধিকার আদায় হয় না। মায়ের অধিকার তার প্রাপ্য মোতাবেক আদায় করতে হয়। এটাই ইসলামের বিধান ও নির্দেশনা।
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের নাম মায়ের কোল। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে দেখা যাচ্ছে সেই মায়ের কোলও সন্তানের জন্য আর নিরাপদ নয়। হালে অনেক মা পরকীয়ার টানে এতোটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন যে, নিজের হাতে নিজের সন্তানকে হত্যা করতে দ্বিধা করছেন না। যে সন্তানের সুখের জন্য মা তার সবকিছু বিসর্জন দিতেন, এখন ওই মা নিজের সুখের জন্য সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছেন। যা মানবতার চরম বিপর্যয়ের লক্ষণ। এটা ভয়ঙ্কর এক সামাজিক দুর্যোগ। চলমান অবস্থা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এর উত্তরণের জন্য কাজ করতে হবে। এবারের মা দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘন্টা, মে ০৮, ২০১৬
এমএ/