নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নেক আমল। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব।
প্রথম ওহি অবতরণের দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহস দিতে যেয়ে হজরত খাদিজা (রা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে অসম্মান করবেন না। কেননা, আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক রক্ষা করেন। ’ -সহিহ বোখারি : ৩
হজরত খাদিজা (রা.)-এর এ মন্তব্য থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লেখযোগ্য একটি চারিত্রিক সুন্নত। সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আর আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞ্চা করে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। ’
নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করার অর্থ হলো- তাদের বাড়িতে যাতায়াত করা, দাওয়াত করে তাদের বেড়াতে নিয়ে আসা, তাদের খাওয়ানো, তাদের দেওয়া খাবার খাওয়া, বিভিন্ন উৎসব-পর্ব উপলক্ষ্যে সাধ্যমতো তাদের উপহার দেওয়া, তারা উপহার দিলে তা সানন্দে গ্রহণ করে নিজের খুশি প্রকাশ করা, বিপদের সময় সাধ্যমতো তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, সুখে-দুঃখে অংশীদার হওয়া ইত্যাদি।
এভাবে নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে গেলে যে সময় ও অর্থ ব্যয় হবে, মহান আল্লাহ ভিন্নভাবে তা পূরণ করে দিবেন। শুধু পূরণ করেই দিবেন না বরং আরও বৃদ্ধি করে দান করবেন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রিজিকের ও হায়াতের প্রশস্ততা কামনা করে; সে যেন আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে। ’ –সহিহ বোখারি : ৫৯৮৫
নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ রাখা বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হারাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ রাখে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ‘ –সহিহ বোখারি : ৫৯৮৪
‘যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে’ সূরা মুহাম্মদের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। নিকটাত্মীয়দের থেকে অসদাচরণ পেয়ে, অসম্মান পেয়ে, বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ পেয়ে বা তাদের থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অনেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করে দেয়। অথচ এ সকল কারণেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করা যাবে না। বরং জান্নাতে প্রবেশের আগ্রহ থাকলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের পাশাপাশি নিকটাত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা নিজের পক্ষ থেকেই করে যেতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিকটাত্মীয়রা সুসম্পর্ক রাখায় যে ব্যক্তি তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে সে প্রকৃতপক্ষে সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়। বরং নিকটাত্মীয়রা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার পরেও যে ব্যক্তি তাদের সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখে সে-ই প্রকৃতপক্ষে সম্পর্ক রক্ষাকারী। ’ –সহিহ বোখারি: ৫৯৯১
আমাদের সমাজের অনেক দানবীর ও ধনীদের দেখা যায়, তারা নিকটাত্মীয়দের দান করার চেয়ে দূরে দান করতে অধিক স্বচ্ছন্দবোধ করে। আবার অনেকেই নিকটাত্মীয়দের কষ্টদায়ক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে দান-খয়রাত, সাহায্য-সহযোগিতা সবকিছু পর মানুষকে করে থাকে। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো- দান-খয়রাত আগে করতে হবে নিজের কাছের আত্মীয়দের। যে যত বেশি কাছের, যে যত বেশি আপন সে দান পাওয়ার ততো বেশি হকদার।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সাধারণ গরিবকে দান করার দ্বারা শুধু দানের সওয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু গরিব আত্মীয়কে দান করার দ্বারা দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যাবে। দান করার সওয়াব আবার আত্মীয়তার সম্পর্ক চর্চা করার সওয়াব। ’ -ইবনে মাজা : ১৮৪৪
একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত মাইমুনা (রা.) নিজের একটি দাসী মুক্ত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি যদি তা না করে তোমার কোনো মামাকে উপহার দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক চর্চা করতে; তবে তুমি বেশি সওয়াব পেতে। ’ –সহিহ বোখারি: ২৫৯৪
মদিনার মসজিদের সামনে বাইরুহা নামে একটি মনোরম বাগানের মালিক ছিলেন হজরত আবু তালহা (রা.)। বাগানটি রাসূলসহ মদিনার সবার কাছে খুব প্রিয় ছিল। মিঠা পানির জন্য সারা মদিনাতে এর সুনাম ছিল। রাসূল (সা.) মাঝে-মধ্যেই এ বাগানে বিশ্রাম নিতেন, এর পানি পান করতেন। ‘তোমাদের প্রিয় সম্পদ দান করা ব্যতীত তোমরা নেককার হতে পারবে না’-সূরা আল ইমরানের এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ‘যেহেতু বাইরুহা বাগানটি আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। তাই তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করলাম। হে রাসূল! আপনি তা গ্রহণ করুন। যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করুন। ’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি যা বলেছ, তা আমি শোনেছি। তবে আমি চাই, তুমি এ বাগানটি তোমার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে দাও। ’ রাসূলের ইচ্ছা অনুযায়ী হজরত আবু তালহা ( রা.) তার দীর্ঘদিনের শখের বাগানটি চাচাতো ভাইদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। -সহিহ বোখারি : ১৪৬২
ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তির জন্য আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে। এটা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মানবিক শিক্ষা। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘন্টা, মে ২৪, ২০১৬
এমএ/