সাধারণ অর্থে মসজিদ মুসলমানের নামাজের ঘর হলেও মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং মুসলমানদের সব ধরনের কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদ মুসলমানদের শিক্ষালয়, পরামর্শ সভাস্থল ও সমাজ-সংস্কৃতির উৎসস্থল।
শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর যে ইসলামিস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে রাষ্ট্রের সচিবালয় ছিল মসজিদে নববী। তিনি সেখানে লোকদের কোরআন শিক্ষা দিতেন, মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করতেন, জ্ঞান শিক্ষা দিতেন, মামলা-মোকাদ্দমার বিচার করতেন। ইসলামি রাষ্ট্রের সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সভা করতেন, বিয়ে পড়াতেন, এমনকি যুদ্ধের কৌশল নিয়ে সাহাবিদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে এমন আরও অসংখ্য কাজ করেছেন বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
বর্তমানে আমাদের সমাজে মসজিদ আছে, মিম্বর আছে, মসজিদে নামাজও হচ্ছে। কিন্তু মসজিদের কর্মসূচিগুলো দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে গেছে। মসজিদগুলো ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। মসজিদগুলো পরিণত হয়েছে শুধু ইবাদতের জায়গায়।
ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃতির উৎসস্থল মসজিদের সেবা ও তত্ত্বাবধানের কাজে যারা আছেন বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবেন কিনা- বলা মুশকিল। অথচ ইসলামে মসজিদ পরিচালনাকারীদের আলাদা ফজিলতের কথা বিবৃত হয়েছে। এখন যদি মসজিদের খাদেম, কমিটি, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা পরিচালনায় নিযুক্তরা মসজিদের কর্মসূচিতে ভিন্নতা এনে মসজিদগুলোকে আবাদের পরিবর্তে মসজিদগুলোকে প্রাণহীন করে তুলেন, তবে সেটা কী ইসলাম সম্মত হবে?
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ইসলামের সহিহ আকিদা, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যাদের কমতি অাছে; তারা মসজিদের খেদমতের জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়। তাহলে মসজিদের সেবা করবেন কারা?
আলোচ্য বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেম) তো সে লোকেরাই হতে পারেন, যারা আল্লাহ এবং পরকালকে বিশ্বাস করেন, নামাজ কয়েম করেন, জাকাত দেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেন না। তাদের সম্পর্কেই এ আশা করা যায় যে, তারা সঠিক-সোজাপথে চলবে। ’ -সূরা আত-তওবা : ১৮
উপরোক্ত আয়াত থেকে মসজিদ পরিচালনায় নিযুক্তদের যে অত্যাবশ্যকীয় যোগ্যতাগুলো থাকতে হবে তা নিম্নরূপ-
এক. তাদের ঈমানদার হতে হবে।
দুই. পরকালের বিশ্বাস এবং জবাবদিহিতা তীব্র অনুভূতি তাদের থাকতে হবে।
তিন. তারা নামাজ কায়েম করবে।
চার. তারা জাকাত দানে অভ্যস্ত হবে।
পাঁচ. তারা নির্ভীক হবে। সত্য উপস্থাপন করতে তারা কারো সমালোচনা বা রক্তচক্ষুকে ভয় পাবে না।
মসজিদের খাদেম বলা হয় তাদের, যারা মসজিদ প্রতিষ্ঠা, সম্প্রসারণ, পরিচালনা ও উন্নয়নের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। মসজিদের খেদমত একটি মহান কাজ। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর ফজিলত সম্পর্কে বহু বাণী উপস্থাপিত হয়েছে। আর এ কারণেই এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়াকে মুসলমানরা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করেন। এজন্য আমরা যারা আল্লাহর ঘরের সেবা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করব, তাদের এ গুণগুলো অর্জন করতে হবে।
কারণ এ শর্ত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত। আর আমরা যারা মসজিদের তত্ত্বাবধায়াক নির্বাচন করব তাদেরও লোক বাছাইয়ের জন্য কোরআনের আরোপিত শর্তগুলোকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে নিছক রাজনৈতিক প্রভাব বলয় বা অন্য কোনো বৈষয়িক বিষয়কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করলে পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হবে।
পবিত্র কোরআনে আরোপিত শর্তগুলোর প্রথমটিতে বলা হয়েছে-
যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহর ‘জাত’ ‘সিফাত’ (গুণ) ‘হুদুদ’ ও ‘ইখতিয়ার’ (ক্ষমতা) বিষয়ক বিশ্বাসগুলো অন্তরের সঙ্গে মেনে নেওয়া, মুখে তা প্রকাশ করা এবং জীবন ও কর্মে সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোই হলো ঈমান। এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কেই ঈমান বলা হয়।
দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে, পরকালে বিশ্বাস করে অর্থাৎ তার মধ্যে তার কাজের ব্যাপারে শুধু মসজিদের অডিটরের কাছে জবাবদিহিতার ভয় নয় বরং পরকালে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি থাকে। এ অনুভূতি তার হিসার-নিকাশে স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।
তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, তারা নামাজ কায়েম করে। মসজিদের খাদেম তথা কমিটির একজন সদস্যকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন এবং সচেষ্ট হতে হবে। সাপ্তাহিক বা বার্ষিক মুসল্লি দিয়ে এ কাজটি চলতে পারে না।
চতুর্থ শর্তে বলা হয়েছে, তারা জাকাত প্রদান করে। অর্থাৎ অর্থলিপ্সা তাদের পেয়ে বসে না। উপার্জিত সম্পদ তারা খোদার নিয়ম অনুযায়ী ব্যয় করে। তারা কেবল ভোগই করে না, ত্যাগ করতেও জানে।
পঞ্চম শর্তে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অর্থাৎ সব কাজে তারা আল্লাহকে ভয় করে এবং সত্য প্রকাশে তারা নির্ভীক। সত্য উপস্থাপন করতে তারা নিন্দুকের সমালোচনা বা অপশক্তির রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না।
মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজে যারা নিয়োজিত হবেন বা যাদের নিয়োজিত করা হবে, তাদের উপরোক্ত মৌলিক গুণাবলীর পাশাপাশি কতগুলো মানবীয়, সামাজিক ও সাংগঠনিক গুণাবলী থাকতে হবে। এগুলো না থাকলে তিনি একজন ভালো ‘আবেদ’ হতে পারবেন, কিন্তু একজন সফল মসজিদ পরিচালক হতে পারবেন না । অপরিহার্য গুণাবলীর পাশাপাশি অপর গুণাবলীর আধিক্যই মসজিদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত করবে এবং মসজিদের আলো দ্বারা আলোকিত হবে সমাজ ও দেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘন্টা, মে ৩০, ২০১৬
এমএ/