বাংলাদেশি আলেমদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক, দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেমে দ্বীন ও মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (৮৫) শনিবার (২৫ জুন) বিকেল সাড়ে ৬টায় ইফতারের কিছুক্ষণ আগে তিনি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান দীর্ঘ দিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত বুধবার সেখান থেকে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার কিছুক্ষণের জন্য তার জ্ঞান ফিরে আসে। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
গতকাল সন্ধ্যার পর তার লাশ মরচুয়ারি অ্যাম্বুলেন্সে গেন্ডারিয়ার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে একনজর দেখতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নামে।
রোববার (২৬ জুন) সকাল ১০টায় ঢাকার গেন্ডারিয়াতে তার ১ম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ জোহর লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা।
দেশের শীর্ষ ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও মদিনা সম্পাদকের জানাজা উপলক্ষ্যে বায়তুল মোকাররম এলাকায় মানুষের ঢল নামে। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় জাতীয় মসজিদসহ আশপাশের সব রাস্তা।
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন তার বড় ছেলে আলহাজ্ব মুস্তফা মঈনুদ্দীন খান। তিনি উপস্থিত মুসল্লি ও দেশবাসীর কাছে তার পিতার মাগফেরাত কামনা করেন। তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে বেলা ১টা ৩০ মিনিটে জানাজা শুরু হয়। ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান।
জানাজার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে তার শবদেহ রাখা হয় ভক্তদের দেখার জন্য।
সোমবার (২৭ জুন) সকাল ১১টায় ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলায় তার নিজ গ্রাম আনসার নগরে ৩য় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৩৫ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলাধীন পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের ছয়চির গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার আনসার নগরে। তার বাবা হাকীম মৌলভী আনসারুদ্দীন খান ও মা রাবিয়া খাতুন।
পাঁচবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৫১ সালে আলিম ও ১৯৫৩ সালে স্কলারশিপসহ ফাজিল পাস করেন। ১৯৫৩ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৫ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ সালে ফিকাহ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাত্রজীবন থেকেই সহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি ১৯৬০ সালে ‘মাসিক দিশারী’, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন ও ১৯৬১ সালে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনা করছেন।
এ ছাড়া তার সম্পাদিত ‘আজ’ এক সময় সাহিত্য মহলে সাড়া জাগায়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৮৮ সালে সৌদিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবিতায়ে আলমে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মাওলানা খান রাজনীতি, সমাজসেবার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বহু অসহায়, দরিদ্র ও এতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সম্বলহীন লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণসহ সার্বিক কল্যাণে তিনি কাজ করে গেছেন। বান্দরবন জেলার কয়েক শ’ উপজাতি পরিবার তার সহযোগিতায় ইসলাম গ্রহণ করে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে তিনি ‘তাওহিদ মিশন’ নামক সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেন।
প্রতীভাধর মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি প্রায় ১০৫ খানা গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। তার সম্পাদিত ‘মাসিক মদীনা’র প্রশ্নোত্তর সঙ্কলন ‘সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব’ ২০ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিবৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। বাংলানিউজ পরিবারও তার মৃত্যুতে শোকাহত। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। কামনা করি আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন তাকে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৬
এমএইউ/