মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করে পবিত্র মদিনায় যেয়ে দেখেন, সেখানকার অধিবাসীরা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দু’টি আনন্দ দিবস উদযাপন করে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে তাদের আনন্দ-উদযাপনে অংশগ্রহণ করবেন কি-না সে ব্যাপারে জানতে চাইলেন।
মুসলিম উম্মাহর জন্য বছরের এ দু’টি দিনকে আনন্দ উদযাপনের দিবস হিসেবে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে একদিকে মানব প্রকৃতির উপরোক্ত আবেদনের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, অপরদিকে দিন নির্ধারণ ও তা উদযাপনের প্রেক্ষাপটে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষণীয় বিষয়ও নিহিত রয়েছে।
আনন্দ দিবস নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ জাতি সাধারণত এমন দিনকে নির্বাচন করে থাকে, যেদিন তাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটেছে। যেমন, খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিবসের স্মৃতিস্বরূপ ‘বড়দিন’ পালন করে থাকে, ইহুদিদের ‘ঈদে ফাসাহ’ ফিরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে বনি ইসরাইলের মুক্তিপ্রাপ্তির স্মরণে উদযাপন করা হয়ে থাকে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রতি বছর সম্মিলিতভাবে আনন্দ-উদযাপন করার মতো স্মরণীয় দিবসের কোনো অভাব নেই। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন পৃথিবীর জন্যই শুধু নয় বরং সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্যই ছিল সর্বাধিক মহাসৌভাগ্যের দিন। যেদিন মহানবী (সা.) কে নবুওয়তের মহান নেয়ামত প্রদান করা হয় এবং বিশ্ববাসীর জন্য সর্বশেষ হেদায়েতের পয়গাম পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ শুরু হয়, সেদিনের শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহাতীত। যেদিন পবিত্র মদিনাকে মহানবী (সা.) নিজের বাসস্থান বানিয়ে ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, সেদিনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও কোনো ধরনের সংশয়ের অবকাশ নেই। যেদিন মহানবী (সা.) তিনশ’ তেরজন নিরস্ত্র ও নিবেদিতপ্রাণ সাহাবিকে নিয়ে বদর প্রান্তরে বাতিলের সশস্ত্র বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন; যে দিনটিকে পবিত্র কোরআনে ‘ইয়াউমুল ফুরকান’ (হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যের দিন) আখ্যা দিয়েছে- সে দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাও অতুলনীয়, অবর্ণনীয়।
এছাড়া মুসলমানদের অতীব আনন্দের সেই দিনটিও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে স্মরণীয়, যেদিন পবিত্র মক্কা বিজয় হয় এবং কাবা গৃহের ছাদ থেকে প্রথমবার হজরত বেলালের (রা.) আজান ধ্বনিত হয়। মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সিরাতে এমন উজ্জ্বল দিবস অসংখ্য রয়েছে, যেগুলোকে মুসলমানদের আনন্দ উদযাপনের জন্য নির্ধারণ করা যেতে পারত। বরং সত্য কথা হলো, উভয় জগতের সম্রাট মহানবী (সা.) -এর পবিত্র জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল এমন শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ, যার মধ্যে মুসলমানরা দ্বীন ও দুনিয়ার কোনো না কোনো মহান দৌলত লাভে ধন্য হয়েছে।
কিন্তু একমাত্র ইসলামেরই বিরল ঐতিহ্য যে, মুসলিম উম্মাহর জন্য বার্ষিক উৎসব ও আনন্দ দিবস নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত দিনগুলোর মধ্য থেকে একটি দিনকেও নির্বাচন করা হয়নি। মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় দৃষ্টিতে আবশ্যকীয় আনন্দ দিবস নির্ধারণ করা হয় ১ শাওয়াল ও ১০ জিলহজকে। অথচ এ দু’দিনের সঙ্গে বাহ্যত ইসলামের ইতিহাসের বিশেষ কোনো আনন্দময় ঘটনা জড়িত নয়। আনন্দের এ দু’দিনকে এমন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, যখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এমন দুটি সম্মিলিত ইবাদত সম্পন্ন করে, যা বছরে মাত্র একবারই পালন করা হয়।
মোটকথা, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য বার্ষিক ঈদ উদযাপনের জন্য এমন কোনো দিন নির্বাচন করেনি, যা অতীতের স্মরণীয় কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত। বরং এমন সব ঘটনার সঙ্গে মুসলমানদের ঈদকে জড়িত রাখা হয়েছে, যা তাদের বর্তমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং প্রতি বছর নতুন করে তার আগমন ঘটে। এর তাৎপর্য এই যে, অতীত ইতিহাসে স্মরণীয় বা পবিত্র যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা এখন অতীতের অংশে পরিণত হয়েছে। অতীতকে নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আদর্শরূপে গ্রহণ করা এবং নিজেদের কর্মপ্রেরণাকে উজ্জীবিত করার জন্য এমন স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীকে স্মরণ করা নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ও জরুরি। কিন্তু সর্বদা অতীতের ঘটনাবলীতে হারিয়ে গিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া অনেক সময় অনেক জাতিকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকেও গাফেল করে দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৬
এমএইউ/