যৌবন হলো জীবনের ঝড়। আমেরিকান এক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কাল বৈশাখির মতোই জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে যেতে পারে।
যেমন সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়ন্ত্রিত কয়েক যুবকের হিংস্র থাবায় সমগ্র বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কাল বৈশাখির মতো ঝড় বয়ে গেছে। বস্তুত যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তার শক্তিমত্তা সীমাহীন কল্যাণের উৎস হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবী আজ অবধি যতটা এগিয়েছে, এটা অবশ্যই যুব শক্তির কল্যাণে।
আইনস্টাইন theory of relativity প্রকাশ করেছিলেন ২৬ বছর বয়সে, নিউটন develop the calculus করেছিলেন ২৮ বছর বয়সে, মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বোখারি (রহ.) ২৩ বছর বয়সে সহিহ বোখারি শরিফ সংকলন শুরু করেছিলেন।
প্রাকৃতিক ঝড় থেকে বাঁচতে যেমন দীর্ঘ মেয়াদি প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়; তেমনি যৌবনের ঝড় থেকে জীবনকে বাঁচাতে চাই শৈশবকালীন সুশিক্ষা। কারণ শৈশবের শিক্ষাই জীবনের ভিত্তি রচনা করে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে-
ক. শিশুর ভবিষ্যত জীবন বিকাশে শৈশবকালীন শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৃহৎ সামাজিক দল হিসেবে পরিবার শিশুর জন্য যে ধরনের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা করে তাই তার সমগ্র জীবন ঋণাত্মক বা ধনাত্মক পথে প্রবাহিত করে।
খ. শিশুর ভবিষ্যত ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামঞ্জস্যতায় তার শৈশবকালীন ভিত্তি একটি আচরণগত নমুনা হিসেবে কাজ করে।
গ. শৈশবকালীন পারিবারিক পরিবেশ শিশুর ভালো বা খারাপ কিংবা সমাজের জন্য কল্যাণকর অথবা ক্ষতিকর হওয়াকে শিক্ষা দেয়।
ঘ. শৈশবকালে শিশু যে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা লাভ করে তা, পরবর্তী শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিবর্তন করা যায়। তবুও একথা সত্য যে, শৈশবের ভিত্তি পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। -রেজাউল করিম, সামাজিক পরিবেশে মানব আচরণ, পৃষ্ঠা- ৮
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের জীবনের প্রথম কথা- ‘লা-ইলাহা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা আরম্ভ করাও এবং মৃত্যুর সময় তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র তালকিন দাও। কেননা যার জীবনের প্রথম কথা ‘লা-ইলাহা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে এবং জীবনের শেষ কথাও ‘লা-ইলাহা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- হবে সে যদি এক হাজার বছররও বেঁচে থাকে তাকে একটি গোনাহ সম্পর্কেও কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে না। -বায়হাকি, শোয়াবুল ঈমান: ৮২৮২
আলোচ্য হাদিস থেকে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যদি কোনো মানব সন্তানের জীবনের প্রথম কথা কালিমাতুত্ তাওহিদ তথা- ‘লা-ইলাহা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দিয়ে শুরু করা যায় এবং তাওহিদের শিক্ষা তার জীবনের ভিত্তি হয়; তাহলে তার সমস্ত জীবন সে শিক্ষার প্রভাবে পরিচালিত হবে এবং মৃত্যুর সময় তার কালিমা নসিব হবে। ফলে তার জীবনে কোনো গোনাহ থাকবে না। তাই কিয়ামতের দিন তাকে কোনো গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাও করা হবে না।
আমরা জানি, প্রত্যেক মানব শিশু যাবতীয় বৈষয়িক বৈশিষ্ট্য শূণ্যাবস্থায় সৎ-অসৎ যেকোনো গুণাবলি ধারণ করার পূর্ণ যোগ্যতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। অতঃপর তাকে শৈশবে যে আদলে গড়ে তোলা হয়; সেভাবেই সে গড়ে ওঠে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেকটি মানব শিশু ফিতরাতের ওপর (মানবিক সৎ গুণাবলি ধারণের ক্ষমতা নিয়ে) জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পরিবার কাউকে ইহুদি বানায়, কাউকে নাসারা বানায় আর কাউকে বানায় মাজুসি। -সহিহ বোখারি: ১৩৮৫, সহিহ মুসলিম: ২৬৫৮
বর্ণিত হাদিসের শিক্ষা হলো- সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে পেতে হলে বাবা-মাকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আর সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে তার জন্ম ও প্রতিপালনের প্রতিটি স্তরে স্বাভাবিক, সুন্দর ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের পেটে সন্তান প্রয়োজনীয় সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে শরীর ও মেধা-মননের অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবীতে আসলে অথবা উত্তপ্ত, বিক্ষুদ্ধ, প্রতিকূল পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে প্রতিপালিত হলে- ওই সন্তান মানব সন্তান হয়েও পাশবিক চরিত্র নিয়ে সমাজে আবির্ভূত হবে। সে শুধু মা-বাবা আর পরিবারের জন্য নয় বরং সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য হিংস্র হায়েনার চেয়েও ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।
লেখক: ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
এমএইউ/