আরবিতে কথা, খবর কিংবা যে কোনো ঘটনাকে ‘হাদিস’ অর্থে ব্যবহারের প্রচলন আছে। তবে পারিভাষিকভাবে ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উদ্ধৃত তার বাণী, কর্ম, মৌনসম্মতি, জন্মগত বা চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট অথবা তার সিরাতকে (জীবনালেখ্য) হাদিস বলা হয়।
কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিকভাবে হাদিসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) যাচাইয়ের কাজটি মুহাদ্দিসরা করে থাকেন। ফলে হাদিসের নামে জালিয়াতি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। জালিয়াতি করলেও সেটা চিহ্নিত করা সহজ আর এটা ভয়াবহ পাপের কাজ। কারণ মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে আমার ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করে; তার ঠিকানা জাহান্নাম। ’
হাদিস একটি ঐশ্বরিক বিষয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এর নাম ‘আল-হিকমা। ’ যেহেতু এটি ওহি, তাই এর স্রষ্টা আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.)। আল্লাহ এবং রাসূলে কোনো সন্দেহ থাকে না বলেই হাদিসও কোরআনের মতোই নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠে। অবশ্য হাদিসটি আমাদের পর্যন্ত যথাযথভাবে পৌঁছল কিনা- তা যাচাইয়ের দাবি রাখে। সনদ, রাবি (বর্ণনাকারী) এবং মতন (হাদিসের মূল ভাষ্য) সম্পর্কে যাচাইয়ের জন্য তৈরি হয়েছে স্বতন্ত্র শাস্ত্র। ‘ইলম আল রিজাল, ইলম আল মুসতালাহ আল-হাদিস এবং সর্বোপরি ইলম আল-হাদিস শাস্ত্র। এভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডে উন্নীতের পর হাদিসের ওপর কোনো রকম সন্দেহ চলে না। হাদিসের বক্তব্য মানা সবার অবশ্য কর্তব্য। না মানলে ইমান থাকে না।
অন্যদিকে ইতিহাসের বর্ণনায়নে ঐশ্বরিকতা থাকে না বলে এতে সন্দেহ থেকে যায়। বলা হয়, ইতিহাস রচনা করে বিজয়ী জাতি। তাই পরাজিতের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিজয়ীর কলম সব সময় বিচারের ধার ধারে না। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ঘটনার হরেক রূপ আমরা দেখি। ঐতিহাসিক বর্ণনা সনদভিত্তিক হয় না বলে একই ঘটনার প্রায় সাংঘর্ষিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ আমরা পেয়ে থাকি। ইতিহাসবিদরা নানা মতলবে ইতিহাসের নামে অহরহ বিভ্রান্তি ছড়ান। এতে ইতিহাসের নামে এক ধরনের জঞ্জালের সৃষ্টি হয়। সত্য কাহিনী চাপা পড়ে যায়। বার বার বর্ণনার ফলে বহু মিথ্যাকেও ‘সত্যে’ পরিণত করতে সচেষ্ট হোন ঐতিহাসিকরা।
হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস
সমাজ, রাষ্ট্র, প্রথা-অভ্যাস, কীর্তি, সভ্যতা, বংশধারা ও তাদের মৃত্যুর অতীত অবস্থা সম্পর্কে যে শাস্ত্রে আলোচনা হয় তাই ইতিহাস। এর সংশ্লিষ্টতা ইসলামের সঙ্গে হলে তা হয় ইসলামের ইতিহাস।
এই ইসলামের ইতিহাসের, বিশেষ করে এর রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্ণনা দিতে গিয়েও ঐতিহাসিকরা সেই ভুলগুলোই করেছেন, যে ভুলগুলো সাধারণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। হাদিস শাস্ত্রের মতো ইতিহাসের বর্ণনাসূত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সূক্ষ্ম ও নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার ফলে এতে প্রচুর জালিয়াতি রয়েছে। এমনকি ইসলামের মহান সেবক সাহাবিদের সম্পর্কেও ইতিহাসের নামে এমন জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে; যেগুলো বিশ্বাস করলে ইমান নষ্ট হওয়ার মতো ভয়াবহ আশংকা রয়েছে।
বিশেষ করে খলিফা হজরত উসমান, হজরত আলী, হজরত আয়েশা, হজরত মুয়াবিয়া, হজরত আমর ইবনুল আস (রা.)-এর মতো বিখ্যাত সাহাবিদের ব্যাপারে যেসব মিথ্যাচার করা হয়েছে- তা বিশ্বাস করলে ইমান নষ্ট হয়ে যায়। কারণ সাহাবিদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখার সম্পর্ক সরাসরি ইমানের সঙ্গে।
অথচ একই বিষয়ে সাহাবিদের থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো অধ্যয়ন করলে কিংবা বর্ণিত ঐতিহাসিক সূত্রগুলোকে হাদিসের সনদের মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিলে সাহাবিদের ওপর অনাস্থা কিংবা ইমানহারা হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। সাহাবিদের মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার মতো জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ করতে হয় না।
তাই ইসলামের অতীত ইতিহাস বুঝার জন্য ‘ইতিহাস’র চোরাবালিতে পা না দিয়ে হাদিসের সনদভিত্তিক বর্ণনার ওপর নির্ভর করা চাই। কারণ ইতিহাসের স্রষ্টা ‘ঐতিহাসিক’, ওহি এবং হাদিসের স্রষ্টা আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.)।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৬
এমএইউ/