ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

হজের খুতবায় উগ্রপন্থা পরিহারের আহ্বান

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৬
হজের খুতবায় উগ্রপন্থা পরিহারের আহ্বান শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস

সৌদি আরবের মসজিদুল হারামের প্রধান ইমাম ও খতিব শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজিদের উদ্দেশে মসজিদে নামিরা‍ থেকে খুতবা প্রদান করেন।

স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে তিনি খুতবা শুরু করেন।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আরাফার খুতবা দিলেন নতুন খতিব। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আশ শায়খ স্বাস্থ্যগত কারণে খুতবা দেওয়া থেকে অবসর নিলে শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইসকে নতুন খতিব নির্বাচন করা হয়।

খুতবা প্রদানকালে মসজিদে নামিরায় উপস্থিত ছিলেন মক্কা শরিফের গভর্নর প্রিন্স খালেদ বিন ফায়সাল আল সৌদ, গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আশ শায়খসহ সৌদি আরবের সামরিক-বেসামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও আমন্ত্রিত বিশিষ্টজনরা।

নতুন খতিব শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস লিখিত খুতবা পাঠ করেন। ৪৫ মিনিটব্যাপী খুতবা শেষ হয় স্থানীয় সময় দুপুর ১টায়।

হজের খুতবার শুরুতে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, নবী করিম (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করে মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিদায় হজের ভাষণ বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষণীয়
হজের খুতবায় শায়খ সুদাইস বলেন, আল্লাহতায়ালার মেহমান হাজিদের সঙ্গে পবিত্র স্থান জাবালে রহমতে এসে একত্রিত হয়েছি। এ জন্য আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করছি। আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ যে, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পবিত্র এই দিনে এই পবিত্র স্থানে একত্রিত হয়ে তার কাছে দোয়া করার সুযোগ দান করেছেন।

খুতবায় তিনি বলেন, এই পবিত্র স্থানেই আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দেন। সেই ভাষণে বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে।

‘যে গালি-অভিশাপ দেয়, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়’
তিনি বলেন, ইসলামে সুদকে হারাম করা হয়েছে, ইসলামে অজ্ঞতা-মুর্খতা কোনোটারই স্থান নেই। ভুলেও কাউকে গালি দেওয়া যাবে না। যে গালি-অভিশাপ দেয়, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়’।

প্রিয় উপস্থিতি! হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এই পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে, এই জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে তিনি এসব কথা বলেছিলেন।

নবী বলেছেন, আমরা সবাই মুসলমান। মুসলমান কাকে বলে? যতো কঠিনই হোক না কেন, অথবা আমাদের মনপুত হোক বা না হোক, আল্লাহ যা নির্দেশ করেছেন, যে তার সেই নির্দেশের অনুগামী হয় সেই মুসলমান।

হে আল্লাহর মেহমানবৃন্দ! আমরা সবাই জানি যে, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য এই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আমাদের নিঃশ্বাস বায়ু সীমিত। সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য আমাদের উচিত হলো, আমাদের এই সীমিত সময়কে সবচেয়ে ভালো কাজে ব্যয় করে, দুনিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।

উগ্রতা পরিহার করতে হবে
ইমাম ও আলেমদের উদ্দেশে আবদুর রহমান আস সুদাইস বলেন, আমরা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত। আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি, ভুলে গেলে চলবে না। মানুষকে দ্বীনের পথে আনতে হবে সুন্দর হৃদয় দিয়ে। বলপ্রয়োগ করে ধর্ম প্রচার করা যাবে না। উগ্রতা পরিহার করতে হবে। ইসলাম প্রচারে সব মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে।

খতিব আরও বলেন, আরব-অনারবের কোনো পার্থক্য নেই। জাতি ও দেশ ভেদের পার্থক্য ইসলাম সমর্থন করে না। এটা নবীর শিক্ষা। তিনি এখানে দাঁড়িয়ে এটা বলেছিলেন।

শায়খ সুদাইস বলেন, মুসলমানরা এক অঙ্গভুক্ত। একজনের থেকে আরেকজনকে আলাদা করার সুযোগ নেই। পরস্পরের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা করতে হবে।

বয়ানে তিনি ফিলিস্তিন, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের নির্যতিত মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন এবং তাদের মুক্তি কামনা করেন।

তিনি বলেন, মুসলমানরা ভাই-ভাই। আমাদের সেভাবে চলতে হবে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, সহানুভূতির ধর্ম। ইসলাম গ্রন্থিত হয়েছে ন্যায়বিচার দ্বারা, সততা দ্বারা ও ভালো ব্যবহার দ্বারা। এটা আমাদের মানতে হবে। আপনারা এটা মানবেন, আপনারা নিরাপদ ভূমিতে যেভাবে চলছেন- হজ পরবর্তী জীবনে সেভাবেই চলবেন।

যৌবনে গা না ভাসানোর পরামর্শ তরুণদের
যুবকদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ইসলামের প্রচার ঘটেছে তোমাদের মতো যুবকদের হাত ধরে। তোমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি সেটা ভুলবে না। যৌবনে গা ভাসিয়ে চলবে না। অনেক তরুণ ইসলমের মূল শিক্ষা ভুলে ভিন্ন স্থান থেকে ভুল ইসলাম শিখছে। খতিব তাদের সঠিক ইসলামের পখে ফিরে আসার আহবান জানান।

বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে খতিব বলেন, সারাবিশ্ব সন্ত্রাসবাদের যাতাকলে পিষ্ঠ। এটা কাম্য নয়। সন্ত্রাসীরা সমাজকে অস্থির করে তুলছে, ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

নারীদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে
খুতবায় তিনি নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদশর্নের কথা বলেছেন, তাদের সকল অধিকারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেছেন।   বিশ্ব নেতাদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, মানবতার প্রয়োজনে আলোচনায় বসার আহবান জানিয়েছেন।

আলেমদের রাসূলের উত্তরসূরি হিসেবে আখ্যায়িত করে মানুষকে বিভক্ত না করে, ইসলামের সঠিক বিষয় শেখানোর কথা বলেছেন। মানুষের প্রতি ইসলামের আহ্বানকে সহজ করে উপস্থাপনের পাশাপাশি দলাদলি মুক্ত থাকতে বলেছেন।

সংবাদে মিথ্যা ‍না মেশানোর আহবান
নতুন খতিব হজের খুতবায় বেশ গুরুত্ব দিয়ে মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, মানুষের চারিত্রিক বিষয়টি মনেপ্রাণে গুরুত্ব দেবেন। সংবাদে মিথ্যা মেশাবেন না। মিথ্যা প্রচার করবেন না। সত্য গোপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। মানবতার উপকার হয়, সমাজে শান্তি-স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এমন বিষয় প্রচারের পাশাপাশি ইসলামি আদর্শ ও শিক্ষা প্রচার করবেন।

পুরো খুতবায় ধর্মীয় উগ্রতা ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান নতুন খতিব। মক্কাকে নিরাপদ নগরী উল্লেখ করে এর নিরাপত্তা যেন অটুট থাকে, সে দোয়াও করেন।

ভাষণে শায়খ সুদাইস আরাফার দিনের তাৎপর্যের নানা দিক তুলে ধরেন। স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় খুতবা শেষ হয়। খুতবায় সুন্নতের প্রতি গুরুত্বারোপের সঙ্গে সঙ্গে হজ পরবর্তী চার দিনের কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে বলে দেন।

সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ভালো কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবেন। আল্লাহর ইবাদতে বেশি সময় কাটাবেন, নামাজকে গুরুত্ব দেবেন। নবীর প্রতি দরূদ পড়বেন, তার শাফায়াত প্রত্যাশা করবেন।

বয়ানে তিনি ইসলামের চার খলিফার নাম উল্লেখ করেন এবং তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।

ভাষণের শেষ অংশে দোয়ায় তিনি বিশ্ব শান্তি কামনা করে মুসলমানদের ঐক্য প্রত্যাশা করেন। আত্মশুদ্ধি কামনা করেন। আল্লাহর গুণবাচক নিয়ে নিয়ে মানবতার মঙ্গল কামনা করেন। এসময় কান্নার আওয়াজ শোনা যায় আরাফার মাঠ থেকে।

দোয়ায় তিনি নবীর দেখানো পথে চলার শক্তি কামনা করেন। উপস্থিত হাজিদের জন্য আল্লাহর দরবারে কবুল হজ কামনা করেন। হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য দোয়া করেন। সমগ্র বিশ্বের কবরবাসীদের মাগফিরাত কামনা করেন।

খুতবায় তিনি সৌদি হাজীদের উন্নয়নে গৃহীত সৌদি সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে তিনি বাদশাহর সুস্থতা কামনা করে দোয়া করেন ও দোয়া প্রার্থনা করেন।

দোয়ার মাধ্যমে শায়খ সুদাইস খুতবা শেষ করেন। খুতবার মাঝে বলেন, মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করা বিশেষ কাজ। দীর্ঘ ৩৫ বছর এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে শায়খ আবদুল আজিজ আশ শায়খ খুতবা দিয়েছেন। মানুষকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। নসিহত করেছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি আজ খুতবা দিতে সক্ষম হননি। তার জন্য দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা তার ইলমে, হায়াতে বরকত দান করুন। তাকে সুস্থতা দান করুন। আমিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৬
এমএইউ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।