ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৬
মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিত্তশালী বাজাউদের ডেরায় ঢুকে নতুন করে বিস্মিত হওয়ার পালা। বোর্নিও দ্বীপের আর সব আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর উঁচু ঘরে ওঠার জন্য গাছের গুঁড়িতে খাঁজকেটে বসানো হয়।

সাবাহ (বোর্নিও) থেকে: বিত্তশালী বাজাউদের ডেরায় ঢুকে নতুন করে বিস্মিত হওয়ার পালা। বোর্নিও দ্বীপের আর সব আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর উঁচু ঘরে ওঠার জন্য গাছের গুঁড়িতে খাঁজকেটে বসানো হয়।

কিন্তু বাজাউদের ঘরে ওঠার সিঁড়ি তক্তার। অনেকটা বাংলো টাইপের। দু’পাশে লাল-হলুদ কাপড়ের ডেকোরেশন। নিচে বিশেষ ধরনের সরবত তৈরির পানদান পাতার বাগান।

এখনকার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর ভেতরে এর বিত্তশালীয় তো বটেই, মুসলিম হিসেবেও নিজেদের এগিয়ে রাখতে চায় সামনে। নিজেদের এরা মনে করে মহানবীর (সা.) সরাসরি উত্তরাধিকার।
এখানে এদের গ্রামটা পাহাড়ের কোলে। গহীন বনে গাছপালার ফাঁক গলে আসা আলোক রশ্মি অন্যরকম এক আবহ তৈরি করেছে গোটা এলাকায়। মূল বসতঘরের সামনে পাতার ছাউনির নিচে বাঁশ-পাতার কাউন্টারের ওপর এক আদিবাসী উনুন। কড়াইয়ে স্থানীয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত পামওয়েল ফুটছে। নিজেদের উৎপাদিত চালের গুড়া গুলে নারিকেলের কাটা খোলে কড়াইয়ে ঢালছে এক বাজাউ তরুণী। পরণে তার গলায়-হাতে ফুলতোলা সবুজ জামা। খোপা করা চুলে বুনো ফুলের বেড়। মুসলিম বলেই বোধহয় হাত কাটা জামা পরেনি সে।
ছন ছন করে পিঠা ভাজা হলো কড়াইয়ে। তারপর রাখা হলো বাঁশের ডালার বিশাল এক বুনোপাতার ওপরে। এদের ভাষায় একে বলা হয় কুইন জালা। বাংলাদেশের তেলেভাজা পাপড়ি পিঠার সঙ্গে বেশ মিল।

সদ্য ভাজা সলটেড পিঠা খাওয়ার পর পানদান পাতার জুস শরীর জুড়িয়ে দিলো। এতো্ক্ষণের হাঁটার ক্লান্তি নিমিষে উধাও হয়েছে।  
মূল ঘরের ভেতরে পুরোটা জুড়েই নানা রঙা কাপাড়ের ডেকোরেশন। একপাশে বিয়ের মঞ্চ। ঠিক কোটিপতি বা লাখপতি স্টাইল নয়, কিন্তু আদিবাসী বসত ঘরের বিচারে সবখানেই বিত্ত-বৈভবের ছাপ।

ঘরগুলো ঝকঝকে, তকতকে। মাটি-কাঠের চকচকে জারগুলো থেকে যেনো ঠিকরে বেরুচ্ছে দ্যুতি। ঘরের কোণায় নারিকেল, নারিকেলের খোল আর সবজির সমাহার। দেওয়ালে কোথাও কোথাও বাঁশের বদলে স্তরে স্তরে নাম না জানা কি এক হলদেটে পাতার ঝারল। এদের মেয়েদের থাকার ব্যবস্থাও উপরের বাংকারে। সেখানে ওঠার জন্য কাঠের মই সাজিয়ে রাখা। একপাশের দেওয়ালে ঝুলছে ঢাল-তলোয়ার।


সব মিলিয়ে এদের বসত ঘরে রাজদরবারের একটা আবহ ফুটে আছে। তামা-দস্তার পাত্র এই আবহকে আরো ফুটিয়ে রেখেছে যেনো। ঘরের সঙ্গে ব্যালকনিও আছে এদের।

এদের সমাজে কদর বেশি মেয়েদের। বিয়েতে তাই কনেকে জলহস্তি উপহার দিতে হয় ছেলেপক্ষকে। জলজ আগাছা থেকে এক ধরণের বিশেষ পাউডার তৈরি করে বয়সরোধক প্রসাধন হিসেবে মাখে মেয়েরা।

বাজাউয়ের ভেতর আবার ভাগা আছে দু’টি। এই হাউজটা ভূমিতে বসবাসকারী বাজাউদের। ঘোড়া দাবড়ানোতে বিশেষ পারদর্শীতার কারণে এদের বলা হয়ে থাকে ‘প্রাচ্যের কাউবয়’। অপরভাগটা ‘সাগরের যাযাবর’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের বেদে বহরের মতো লম্বা নৌকায় ভেসেই জীবন কাটতো তাদের।

মূলত দক্ষিণ ফিলিপাইনের সুলু সাগরের উপকূল থেকে ওরা আসে বোর্নিওতে। জলের গভীরে ডুব দিয়ে ওষুধী আগাছা তুলে আনতে জুড়ি নেই তাদের্। এক ডুবে তারা চলে যেতে পারে সাগরের শত মিটার গভীরে। খোলা বাতাসে নি:শ্বাস নেওয়া ছাড়াই টানা ১০ মিনিট ডুবে থাকতে পারে পানির নিচে।


পর্তুগিজ, ডাচ বা ব্রিটিশরা আসার আগেই আরব সুফীরা এসে এদের ভেতরে ইসলামের বাণী প্রচার করে দিয়েছে। তবে সাগরে ভাসা বাজাউদের ভেতর সাগর দেবতা ওমবো দিলাউতের আরাধনার চল আছে।

এদের জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে বর্ণিল উৎসব আর হৃদয় ছোঁয়া গান। আরো আছে ফোকলোর সাহিত্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাজাউ নামেই এক বিশাল দেহী ব্যক্তি ছিলো তাদের সমাজে। কোনো নদীতে সে সাঁতরে গেলে তার শরীরের চাপে ফুলে উঠতো পানি। ফলে তীরে ওঠা মাছ অনায়াসে দরে ফেলতো তার সম্প্রদায়ের লোকেরা। অপর গোষ্ঠীর লোকেরা এতে বিরক্ত হয়ে ফন্দি আঁটে তাকে হত্যার। ছুঁড়ে দেয় বিষমাখা ছুরি। তার সমাধীতে তারই বয়ে আনা বিশাল এক পাথর কোনো মানুষের পক্ষে টেনে তোলা সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস প্রচলিত বাজাউ সমাজে।

আরও পড়ুন

**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী​
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।