ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ভাঙলো তুরাগ তীরের মিলনমেলা

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৭
ভাঙলো তুরাগ তীরের মিলনমেলা ভাঙলো তুরাগ তীরের মিলনমেলা/ছবি: কাশেম হারুন

জিকির ও তাকবিরের ধ্বনির পাশাপাশি ও মাইকে ভেসে আসা দরদমাখা দ্বীনি আলোচনা, অলি-গলিজুড়ে টুপিওয়ালা মানুষের ভীড়, বাসায় বাসায় আত্মীয়দের আনাগোনা, মসজিদে মসজিদে মুসুল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি, লোকারণ্য বাজার-ঘাট ইত্যাদির আবহ উৎসবের রূপ নেয় সোনাভানের টঙ্গী।

বিশ্ব ইজতেমা চলাকালীন সময়ে টঙ্গীর পরিবেশে এক ধরনের আধ্যাত্মিক আবহ বিরাজ করে। কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগের পানি আগের নিয়মে শান্তভাবে বইতে থাকলেও তাতে অন্যরকম এক দ্যুতি ভর করে।

তুরাগের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মাঝে আল্লাহপ্রেমিকরা খুঁজে পান ঐশ্বি ধ্বনি। তাইতো এই তীরে গভীর রাতে ঠায় দাঁড়িয়ে কথোপকথনে মত্ত হন নবীপ্রেমিকরা। কথা বলেন তারা নামাজে দাঁড়িয়ে কোরআনের ভাষায়। এ এক অপার্থিব পরিবেশ। সব কী আর বলে বা লিখে বুঝানো সম্ভব?

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা। আল্লাহর পাগল, নবীপ্রেমিকদের মিলনমেলা। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এ বছরের জন্য শেষ হলো এই মিলনমেলা। এই মিলনমেলার কোনো প্রচার-প্রচারণা নেই, নেই সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি। শুভেচ্ছা স্বাগতম স্লোগানও নেই। এখানে আসা প্রত্যেকেই যেন সভাপতি, তারাই অতিথি, তারাই সেবক। এমন আত্মবিসর্জন দেওয়া মিলনমেলার প্রভাবে কী না হতে পারে সমাজে?

পক্ষকালব্যাপী চলা এই মিলনমেলার আলোই দেশের আড়াই লাখ মসজিদে জিইয়ে রাখে তালিমের পরিবেশ। প্রাণবন্ত করে তুলে বয়স্ক থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কোরআন শিক্ষার আসর। তরুতাজা রাখে নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অন্যের হিত কামনার মতো মনোভাব। এইবা কম কীসে?
 
দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। এর পর ১৩ তারিখে শুরু হওয়া এ মিলনমেলা দেখতে দেখতে কখন যে ফুরিয়ে গেল তা টেরই পাওয়া গেলো না। সকাল সোয়া এগারোটার দিকে গুরুগম্ভীর কন্ঠের আখেরি মোনাজাত শেষ হতে না হতেই নিভে গেল তুরাগ তীরের আলোর মশাল। তখন মনে হলো- হায়! শেষ হয়ে গেল বিশ্ব ইজতেমা! নিভে গেলো আলোর মাহফিল!!

হ্যাঁ, বাস্তবিক অর্থেই রোববার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে ভাঙলো তাবলিগি সাথী থেকে শুরু করে বাঙালি মুসলমানদের এ বৃহৎ মিলনমেলা। আজ থেকে টানা ১১ মাসের জন্য ফাঁকা হয়ে পড়বে পুরো ইজতেমার মাঠ। কানে আর ভেসে আসবে না শত কন্ঠের মুয়াজ্জিনের তাকবিরের ধ্বনি। শোনা যাবে না বয়ান মঞ্চের কোনো ঘোষণা। থাকবে না দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ‘গাট্টিওয়ালা’ মানুষের আনাগোনা।

দুই পর্বে দুই সপ্তাহ ধরে দেশের ৩২টি জেলার মানুষ দ্বীনি পরিবেশে থেকে আজ ফিরে যাচ্ছেন যার যার ঘরে। নিজ নিজ পরিমণ্ডলে গিয়ে এই মানুষগুলো আগামী এগারো মাস অন্যদের ডাকবে আল্লাহর পথে, মসজিদের পানে। উপদেশ দিবে সৎ কাজ করতে, নিষেধ করবে অসৎ-অনাচার থেকে।

মাঘের হালকা কুয়াশা ভেদ করে সকালের মিঠে রোদে লাখো মানুষ সম্মিলিতভাবে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কেঁদে কেঁদে শক্তি প্রার্থনা করেছেন এসব কাজের। যে শক্তি আজ থেকে ব্যয় হবে সমাজের তাবৎ অশুভ চিন্তা ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে। ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে তারা সমৃদ্ধি কামনা করেছেন সৎভাবে, সুখ চেয়েছেন বৈধ পন্থায়।
ভাঙলো তুরাগ তীরের মিলনমেলা/ছবি: কাশেম হারুনসাধারণ মানুষ, সেবাপ্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার লোক ও তাবলিগি সাথীদের সরব উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল তুরাগের শুষ্ক তীর। পড়ন্ত বিকেলে বেদনার সুর ছাপিয়ে পরের বছরের ইজতেমায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা সম্বলিত বীজ বুনে একে একে চলে যাচ্ছেন সবাই। চলার পথে সঙ্গে নিচ্ছেন নিজের মতো করে কিছু স্মৃতি।
 
বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বে টঙ্গীতে এসেছিলেন প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এসেছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার মহাদেশের প্রতিনিধিরাও। দিনে দিনে অংশগ্রহণকারী মানুষ ও দেশের সংখা বাড়ছে। বাড়ছে ইজতেমার পরিধিও।

সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের গণমাধ্যম বিশ্ব ইজতেমার খবরাখবর নিজ দায়িত্বে অত্যন্ত কষ্ট করে সততার সঙ্গে পরিবেশন করে থাকেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য ও সরকারের উচ্চ পদস্থ আমলা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের সাগ্রহ অংশগ্রহণের এমন মিলনমেলা দেশে আর একটিও নেই। এই যে ভাবনার আদান-প্রদান, সংহতির চিত্র ও ঐক্যের আবহ এটা সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হোক জীবনের পরতে পরতে। এই প্রত্যাশা কী বেশি কিছু?

কিশোরগঞ্জের প্রবীণ তাবলিগের সাথী আসলাম মিয়া বলেন, ‘এখানে নবীপ্রেমের, মহাসম্মেলন বসেছিল। লাখ লাখ লোকের আগমন। এখন বাড়ি ফিরব। যা শুনলাম সেভাবে আমল করার চেষ্টা করবো। ’

আরেক মুসুল্লি পাবনার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন চিল্লার জন্য নাম লিখিয়েছি। বাড়ি ফিরবো না, বাবা এসেছেন তিনি বাড়ি যাবেন। জীবনে তো অনেক কিছু করলাম। এবার দেখি, যদি মনটা বাঁধতে পারি। ’

সমাজে চলমান নানাবিধ অনাচার আর পাপাচারের মাঝে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সঙ্গে মন বাঁধার এই মিলনমেলা সফল হোক, মিলনমেলা ভাঙার বিরহ নয়; হৃদয়মনে বিজয়ী হোক এখান থেকে অর্জিত শক্তির।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৭
এমএইউ/

** চোখের পানিতে গুণাহ মাফের ফরিয়াদ
** বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শুরু

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।