এমনকি কোনো কোনো মসজিদ তাদের নামেও পরিচিত। সুলতানি, মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলের সুবেদার বা আঞ্চলিক শাসকরা অনেক সময় তাদের মা, স্ত্রী ও কন্যাদের নামে মসজিদ নির্মাণ করেন।
হাল সময়ে বাংলাদেশের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম এ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন। এই নারী স্থপতি ২০১৬ সালে লাভ করেছেন আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক এ পুরস্কার। রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদের বায়তুর রউফ মসজিদের নকশার জন্য তিনি এ পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
বায়তুর রউফ মসজিদের অবস্থান রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়েদাবাদে। ঢাকার প্রবেশমুখ আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে রেললাইন পেরিয়ে মসজিদে যেতে হয়।
এই স্থাপত্যের বিশেষ দিক হলো- এর বায়ু চলাচলব্যবস্থা ও আলোর চমৎকার বিচ্ছুরণ মসজিদের পরিবেশকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ৭৫৪ বর্গমিটারের মসজিদটির বিশেষত্ব হলো, এখানকার মসজিদের পরিচিত চিত্র মিনার নেই। চতুর্দিকে আটটি পিলারের ওপর এটি তৈরি। এর নকশার বিশেষত্ব হলো- কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আলো প্রবেশের জন্য চারদিকে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে এর স্থাপত্য।
মেরিনা তাবাসসুম ২০০৫ সালে যখন এই মসজিদের নকশা করার দায়িত্ব পান। বায়তুর রউফ মসজিদের নকশার কাজ শুরুর আগে প্রায় একশটি মসজিদ ঘোরেন তাবাসসুম। ২০১২ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর ঢাকার ‘বিনত বিবি মসজিদ’ অন্যতম। নারিন্দায় এই মসজিদের অবস্থান। ১৪৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি দুই গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের প্রবেশ দ্বারে খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, ১৪৫৭ সালে মরহামত কন্যা বখত বিন বা বিনাত বিবি এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
ঢাকার আরেকটি প্রাচীন মসজিদ হলো- সিংটোলার সিতারা বেগম মসজিদ। বাংলাবাজার প্যারিদাস রোডের পাশে অবস্থিত মসজিদটি। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে সিতারা বেগম নির্মাণ করেন।
ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় ১১১৮ হিজরি সালে মরিয়ম সালেহা মসজিদটি নির্মিত হয়। এটি বাবুপুরা শাহসাহেব বাড়িতে অবস্থিত।
অন্যদিকে ধানমন্ডির হাতীরপুল এলাকার বাইতুল মুবারক মসজিদটির নির্মাতা গোলেছা বিবি। ৩ হাজার বর্গফুটের এই মসজিদটি ১৯৬০ সালে নির্মিত।
বাহাদুর শাহ পার্ক মসজিদটি নির্মাণ করেন নান্নী বিবি। নির্মাণকাল ১২৩১ হিজরি। আয়তন ৩ হাজার বর্গফুট।
বেগমগঞ্জ আছিয়া মসজিদ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করেন আছিয়া বেগম। ভাটিখানা মসজিদ কাদের বিবি ১৭৫৭ সালে নির্মাণ করেন। আরমানিটোলা বাঘের মসজিদটি ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দা বিবি নির্মাণ করেন। জিন্দাবাহার কামরাঙ্গা মসজিদ নির্মাণ করেন আকতারুন্নেছা।
এছাড়া ফখরুন নেছা ১৮৬০ সালে হাজারীবাগে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। লক্ষ্মীবাজার শাহ সাহেব বাড়ি মসজিদটির নির্মাণকাল ১৮৫০ সাল। এক গম্বুজ বিশিষ্ট দ্বিতল এ মসজিদের নির্মাতা লুৎফুননেছা।
রঙ্গী বিবি ঢাকার ইবরাহীমপুর বাইতুস সালাম মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত।
জুরাইন বুড়ির মসজিদ ১৯৬৬ সালে স্থাপিত। নাম না জানা এক বিধবা মহিলা কর্তৃক এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
তেজকুনীপাড়ায় রয়েছে পীরমা কর্তৃক স্থাপিত পীরমা জামে মসজিদ। মসজিদটি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত।
মিরপুর নবাবেরবাগ উত্তরপাড়া জামে মসজিদটি ১৯১০ সালে মালেকা খাতুন কর্তৃক নির্মাণ করা হয়। আবার তেলীপাড়া মসজিদটির নির্মাতা মাকতি বিবি। ইনতুন নেসা বিবি শ্যামপুর আলী বহর মসজিদটি ১৯১০ সালে নির্মাণ করেন।
একলাছ বিবি ও উলাছি বিবি ১৯২০ সালে খিলবাড়ী মসজিদটি নির্মাণ করেন। রাহেলা খাতুন বাংলা ১৩৪৪ সালে দক্ষিণ শাহজাহানপুরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ফয়জুন বিবি ১৯৪০ সালে কাজলায় বায়তুল জান্নত মসজিদ নির্মাণ করেন।
গোলেছা বিবি ১৯৬০ সালে ধানমন্ডি বায়তুল মোবারক মসজিদ নির্মাণ করেন। সুফিয়া বেগম ১৯৬৫ সালে খিলক্ষেত নতুন বাজার মসজিদ নির্মাণ করেন। সমিরুন নেসা ও নুরজাহান খাতুন ১৯৬৪ সালে চিড়িয়াখানা মসজিদ নির্মাণ করেন। কুলসুম বিবি ১৯৭৪ সালে শাহজাহানপুরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মাজেদা খাতুন ১৯৭৮ সালে কাজলারপাড় মসজিদ নির্মাণ করেন।
কুরশিয়া বেগম ১৯৮৪ সালে রামপুরা দারুস সালাম মসজিদ নির্মাণ করেন। নুরবানু ১৯৩৮ সালে নিউ ইস্কাটন ছোট মসজিদ নির্মাণ করেন। মজিরুন নেসা ১৯৮৩ সালে মিরপুর শাহমকসুদুল আওলিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।
ঢাকার বাইরেও কয়েকটি মসজিদ নারীদের দ্বারা বা তাদের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন- নারায়ণগঞ্জ জেলায় রয়েছে, বিবি মরিয়ম মসজিদ। এটি মুঘল আমলে নির্মিত।
মুন্সীগঞ্জের শহর জামে মসজিদ ১৮৮২ সালে নির্মাণ করেন আক্রামুন নেসা। বগুড়ার বিবির মসজিদ ১৬২৮ সালে নির্মাণ করা হয়।
বিবি বেগুনি মসজিদটি বৃহত্তর খুলনা এলাকায় সুলতানি আমলে নির্মিত হয়। পটুয়াখালী জেলার বিবি চিনি মসজিদও মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত। বিবি মেহের মসজিদটি ১৮১৯ সালে ময়মনসিংহে নির্মাণ করা হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও হয়তো অনেক মসজিদ নারীদের দ্বারা কিংবা তাদের অসিলায় নির্মিত হয়েছে। তাদের মহান কীর্তি মসজিদগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হবে অনন্তকাল। দোয়া করি, এই মসজিদগুলো সদকাতুল জারিয়া হিসেবে তাদের আখেরাতে মুক্তির পথ প্রশস্ত করুক। আমিন।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৭
এমএইউ/