তবে মা-বাবা কখনও কখনও বাধ্য হয়ে সন্তানকে সাময়িক শাস্তি দেন। দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন।
খবরটি খুব ছোট করে বুধবার সহযোগী এক দৈনিকের ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, ধুনটের পাঁচথুপি সরোয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম মাদকাসক্ত ছেলে রিপনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোপর্দ করেন। মঙ্গলবার দুপুরে ধুনট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইব্রাহীম পিতার অভিযোগের ভিত্তিতে রিপনকে ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
পত্রিকাটিতে খবরটি যত ছোট করে ছাপা হয়েছে ঘটনাটি কিন্তু তত ছোট নয়। এই খবরের তাৎপর্য অনেক বেশি। এর মাঝে রয়েছে শিক্ষার অনেক কিছু। স্বাভাবিক রীতিমতে নিজের সন্তানকে কোনো বাবা সহজে আদালতে সোপর্দ করেন না। কিন্তু এখানে এটা ঘটেছে। আমরা দেখেছি, অনেক বাবা অপরাধ গোপন রেখে ছেলেকে শাস্তি থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন। তবে ব্যতিক্রমও মাঝে মাঝে দু’একজন ঘটান। এমন ঘটনা কেবল এটাই নয়; এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে এদেশে।
অতীতে আরও কয়েকজন মা-বাবা নিজের সন্ত্রাসী, অবাধ্য ও মাদকাসক্ত সন্তানকে পুলিশে অথবা আইনের হাতে তুলে দেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেকে সন্ত্রাসী ও অবাধ্য সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিতও করেছেন। আমরা এও দেখেছি, ছেলে জঙ্গি হওয়ার দরুণ লাশ সৎকারের জন্য গ্রহণ করা তো দূরের কথা, শেষ দেখাও দেখতে আসেনি অনেকে। সর্বশেষ দেখলাম স্নেহময় এক বাবার এমন কঠিন শাস্তি।
রিপনের ঘটনায় কিছুটা অনুমান করা যায় মাদকাসক্তির ভয়াবহতা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে মাদকের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ হলেও এর জমজমাট ব্যবসা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী অ্যালকোহল ছাড়া অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, কেনা, বিক্রি, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যাবে না। এই আইন ভঙ্গকারীদের জন্য যাবজ্জীবন থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
তার পরও মাদকের সয়লাব থামছে না। মাদকের নেশা এমনই এক নেশা, যে নেশার কাছে সমাজ-সংসার সব তুচ্ছ হয়ে যায়। মাদক সেবন করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সর্বনাশা মাদকের ছোবলে বহু সংসার ছারখার হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
মাদকসেবীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে। উল্টো ঘটনাও ঘটছে। মাদক কেনার টাকা না পেয়ে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে খুন হচ্ছেন বাবা-মা। ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছেন ভাই বা বোন। টাকা না পেয়ে মায়ের অলংকার চুরি করে তা বিক্রি করে দিচ্ছে মাদকাসক্ত সন্তান। কেউ কেউ চাঁদাবাজি করছে, কেউ বা করছে ছিনতাই। কেউ করছে শিশু অপহরণ। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে মাদক কিনবে। এভাবে মাদকের কারণে তরুণেরা বিপথগামী হচ্ছে। মাদক ব্যবসা ও সেবনকে কেন্দ্র করে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে।
এত ঘটনা ঘটে চলেছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। আমরা মনে করি, মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেক অঘটন এড়ানো যেত। সেই এড়িয়ে যাওয়ার কার্যকর উপায় নিয়ে দ্রুত ভাবা দরকার।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমাজে যখন অবক্ষয় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে; অবিচার-মাদকাসক্তি সমাজে বেড়ে যায়। মা-বাবা কিংবা গুরুজনদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এভাবে সমাজে অস্থিরতা প্রকট হয়ে ওঠে। যুবসমাজ উচ্ছন্নে যায়। নিরাপত্তহীনতা মানুষকে ভয়ার্ত করে তোলে।
ধুনটের ঘটনাটি এমন অস্থিরতা ও সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কের শিথিলতারই লক্ষণ বলা চলে। অন্যথায় একজন স্নেহময় বাবা তার সন্তানকে নিজ হাতে আদালতে সোপর্দ করবেন কেন?
আগের দিনে অবশ্য খলিফা, শাসক অথবা বিচারক বা কাজী সাহেবরা নিজের অপরাধী সন্তানের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দিতে দ্বিধা করতেন না। আজকাল অতীতের সেই উদাহরণ বিরল।
ইসলাম সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলাম মাদককে সব অপকর্মের চাবিকাঠি বলে সাব্যস্ত করেছে। মাদকদ্রব্য যে নামেই হোক আর যে পদ্ধতিতেই গ্রহণ করা হোক, ইসলাম ধর্মে তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাদকের ওপর অভিশাপ, মাদক পানকারীর ওপর অভিশাপ, পরিবেশনকারীর ওপর অভিশাপ, বিক্রয়কারীর ওপর অভিশাপ, ক্রয়কারীর ওপর অভিশাপ, যে মাদক নিংড়ায় তার ওপর অভিশাপ, যার আদেশে নিংড়ানো হয় তার ওপর অভিশাপ, বহনকারীর ওপর অভিশাপ, যার কাছে বহন করে নেওয়া হয় তার ওপর অভিশাপ, আর যে মাদক বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভোগ করে তার ওপর অভিশাপ। ’ –সুনানে আবু দাউদ
ধুনটের পিতা সাইফুল ইসলাম নিশ্চয়ই তার সন্তানকে এমন অভিশাপের মাদকের ছোবল থেকে বাঁচাতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি ছেলেকে ফেরাতে পারেননি। দিন দিন ছেলে রিপন নিশ্চয়ই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল। সেই কেবল মাদক খেতো না। মাদকই তাকে খেতে বসেছিল। আরও বড় সর্বনাশের কবলে হয়তো তলিয়ে যাচ্ছিল ছেলে রিপন। তাই তার নিরুপায় বুদ্ধিমান বাবা বাধ্য হয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করেছেন।
এতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। সব পিতা যদি তাদের মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি সন্তানকে সময় থাকতেই আইন-আদালতের হাতে তুলে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, তাহলে সমাজের অস্থিরতা ও মানুষের উদ্বেগ অনেকটা এমনিতেই কমে যাবে। আমরা রিপন মাহমুদের পিতা সাইফুল সাহেবকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতি আহবান জানাই, মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচলানার।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৫১ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
এমএইউ/