পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার এক গ্রামে ছেলে তার অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে গোয়ালঘরে রাতে থাকতে বাধ্য করেছে। রাতে পাশের জঙ্গলের শিয়াল এসে ঘুমন্ত ও অসহায় বৃদ্ধাকে কামড়ে দেয়।
অবশেষে গত রোববার (২৮ মে) তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারদের মতে, রাতে হয়তো একাধিক শিয়াল ৮৫ বছরের বৃদ্ধা মরিয়মকে কামড়ে দিয়েছে।
ভাগ্যহত এই বিধবা নারীর তিন ছেলে। বড় ছেলে একটি সাধারণ চাকরি করে। অন্য দু’জন দিনমজুর। তিন ভাই পালা করে মায়ের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব পালনের কথা। তবে তারা বরাবরই মাকে মনে করে একটা বড় বোঝা।
স্থানীয় লোকজন জানান, ওরা মায়ের প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়ে আসছিল। পালামাফিক বৃদ্ধা মরিয়মকে দেখাশোনার ভার গত ২৫ মে যে ছেলের ওপর পড়ে, সে খুবই রেগে যায় মাকে দেখে। এমনকি রাতে সে অত্যন্ত বৃদ্ধা মাকে পলিথিনের ছাউনি দেওয়া গোয়ালঘরে থাকতে বাধ্য করে। এরপরই ঘটে শিয়ালে কামড়ানোর মর্মন্তুদ ঘটনা।
সন্তান যখন কয়েক দিনেও মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি, তখন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বৃদ্ধাকে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে অবস্থা মারাত্মক হওয়ায় তাকে মেডিক্যাল কলেজে পাঠাতে হয়েছে। ইউএনও জানান, অসহায় মরিয়মের চিকিৎসার জন্য সরকারি তহবিল থেকে ১৩ হাজার টাকা সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার কয়েকদিন আগে ফরিদপুরে এক মা’কে আদালতের দারস্থ হয়ে ছেলের কাছ থেকে ভরণ-পোষণের অর্থ পাওয়ার আদেশ নিতে হয়েছে। খবরে প্রকাশ, ভরণ-পোষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মা-বাবার কাছ থেকে সম্পত্তি লিখে নিয়ে প্রতারণা করায় ছেলে সেলিম সরদার ওরফে মধুর (৩৫) বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মা জহুরা বেগম।
গত ১৭ এপ্রিল ফরিদপুরের ৪নং আমলি আদালতে মা জহুরা বেগম বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। আদালতের বিচারক মো. সুমন হোসেন মামলাটি আমলে নিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ব্যাসদী গ্রামের বৃদ্ধ দম্পত্তি জহুরা বেগম ও পাঁচু সরদারের দুই ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলে মুরাদ সরদার অনেক দিন আগে বাড়ি ছেড়েছেন। ছোট ছেলে মধু ২০১১ সালে মা-বাবার দেখাশুনার কথা দিয়ে বসতবাড়ির জমি তার নামে লিখে নেন। দীর্ঘদিন বাবা-মায়ের তেমন কোনো খোঁজ খবর নেননি। উপরন্তু চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মধু তার মা-বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রতিদিন দু’জনের জন্য ১০০ টাকা করে তার কাছে ভোরণ-পোষণের খরচ দাবি করেন। কিন্তু তাতেও মধু রাজি না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন জহুরা বেগম।
২৩ মে আদালতের নির্দেশে সমন পেয়ে সেলিম সরদার হাজিরা দিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন প্রার্থনা করেন। আদালতের বিচারক মো সুমন হোসেন তার জামিন মঞ্জুর করে প্রতি মাসের ২৫ তারিখের মধ্যে তার মা ও বাবার ভরণপোষণ বাবদ এক হাজার পাঁচশ টাকা দেওয়ার আদেশ দেন।
উল্লেখিত দু’টো ঘটনাই অমানবিক। এগুলো সভ্য সমাজের কলংক। বস্তুত মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ঋণ কোনো দিন পরিশোধ করা সম্ভব নয়। সব ধর্মেই মা-বাবার প্রতি ছেলেমেয়ের দায়িত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম শুধু এই গুরুত্বই দেয়নি, বরং বলা হয়েছে- ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। ’
অর্থাৎ সন্তান মায়ের উপযুক্ত সেবাযত্নসহ তার প্রতি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে নিজের পরকালীন মুক্তির পথ সুগম হবে। অথচ আজকের সমাজে আমরা দেখছি উল্টো চিত্র।
শুধু যে গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারেই মায়ের প্রতি অমানবিক আচরণ কখনও কখনও দেখা যায় তা নয়। শহরাঞ্চলের আধুনিক, উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তবান পরিবারেও এটা পরিলক্ষিত হয়। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজের কথিত প্রগতিশীলতার অনুকরণে আমাদের দেশেও অসহায় মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। যুগের বৈরী হাওয়ায় যৌথ পরিবারপ্রথা বিলীয়মান হওয়ায় মা-বাবাকে ঠাঁই নিতে হচ্ছে স্বজন থেকে দূরে, বৃদ্ধাশ্রমে।
মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ববোধ, তথা ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বন্ধন ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এ জন্য নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের পাশাপাশি পারিবারিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। ধর্মীয়ভাবে পিতা-মাতার সম্মান, সন্তানের দায়িত্বগুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করতে হবে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৭
এমএইউ/