ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

অপরাজিতা: বৃষ্টিহীন বন্ধ্যা আকাশে একটি বিনয়ী ‘না’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৭
অপরাজিতা: বৃষ্টিহীন বন্ধ্যা আকাশে একটি বিনয়ী ‘না’ অপরাজিতা: বৃষ্টিহীন বন্ধ্যা আকাশে একটি বিনয়ী ‘না’

গতানুগতিক ধারার মনে করে কাগজটি আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ঘটনাচক্রে এক সময় তা আমার হস্তগত হয় এবং পড়তে গিয়ে আমি বেশ বড়সর একটা ধাক্কা খাই।

ধাক্কা খাওয়ার সেই গল্পটি হলো-

‘অপরাজিতা’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হয় বেশ কিছু দিন আগে। তখনও জানতাম না এটা মাসিক না দ্বি-মাসিক।

কয়েকজনের ওয়ালে ছোট্ট পরিসরে এর কয়েকটি রিভিউ দেখেছিলাম। কিন্তু ভেতরের জিনিসপত্র সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। তবে, নামটা বেশ ভালো লেগেছিলো, অন্য অনেকের ভেতর একটু অন্যরকম- এই যা।

হাতের কাছে থাকলে হয়তো সংগ্রহ করতাম। কিন্তু পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে। সংগ্রহ করতে হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, ডাকে আনাতে হবে, এরপর ডাকখানা থেকে নিজে গিয়ে উঠিয়ে আনতে হবে- ‘অপরাজিতা’ আর আমার মাঝখানের এই দূরত্বটুকু পার হওয়ার মতো সময় তখন আমার ছিলো না। যথারীতি একসময় এর কথা ভুলেও গেলাম।

এরপর একদিন এর সফট কপি সংগ্রহ করার সুযোগ মেলে। আর ‘মুফতে’ পাওয়া এরকম একটা জিনিস হাতছাড়া করতে হলে কলিজাটা একটু বেশি রকমের চওড়া হতে হয়। আমি অবশ্য ওমন চওড়া কলিজার মালিক কখনোই ছিলাম না। তাছাড়া যে জিনিসটি কিছু মানুষ একটা সীমাহীন আবেগ, আনন্দ আর যত্ন নিয়ে গড়ে তুলেছেন, এমন জিনিস সুগন্ধময় হবেই। একে হেলায় হারানো অমানবিকও বটে। আমার ধারণা স্বার্থগত দিক থেকে এটা অনেকটা অপরাধের পর্যায়েও পড়ে।

যাই হোক, আমি পিডিএফ কপিটি সংগ্রহ করে পড়তে বসলাম এবং পড়তে গিয়ে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। মাফ করবেন, এখানে আমি এ পত্রিকাটির শুধু প্রশংসাই করবো। যেহেতু প্রশংসা ছাড়া অন্য কিছু করার এখানে আসলে সুযোগই নেই এবং আমি বলছি যে, চমকে উঠার কারণটি আমি পরে বলবো। তার আগে চলুন উড়ন্ত দৃষ্টিতে পত্রিকাটির ভেতরের জিনিসপত্রের সঙ্গে একটু পরিচিত হয়ে নিই।

নাম: অপরাজিতা। ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা। সম্পাদক: আফিফা মারজানা। সম্পাদনা সহযোগী: নাঈমা তামান্না ও সুমাইয়া ইয়াসমিন তামান্না। প্রচ্ছদ: জুবায়দা ফারজানা। যোগাযোগের ঠিকানা: ইসলামি টাওয়ার, বাংলাবাজার, ঢাকা। পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৫৮। পত্রিকাটির দাম রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা।

এই পত্রিকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কাজটি করেছেন নারীরা। লেখকদের সবাই নারী। প্রচ্ছদ সুন্দর এবং শৈল্পিক। পত্রিকাটির অঙ্গসজ্জা, বর্ণ-বিন্যাস, কভারে জলরঙের ব্যবহার ইত্যাদি আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। আপাতত সংক্ষেপে এটুকু বলি- পরিমিত, রুচিশীল, মুগ্ধকর এবং সুসংহত। যে কোনো পত্রিকার চেয়ে অপরাজিতার বিষয়গুলো উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম।

অপরাজিতার প্রথম সংখ্যার নাম- সাহাবিয়া। অর্থাৎ সবগুলো রচনাই নারী সাহাবিদের নিয়ে। মন ভালো করা অপূর্ব কিছু শিরোণামের অধীনে মুসলিম নারীদের সত্যিকার আদর্শ নারী সাহাবিদের ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুন্দর শব্দচিত্রে, পরিমিতভাবে, ভক্তি-শ্রদ্ধা আর প্রেমের মোহন মায়ায়।

এতে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ১৯ টি রচনা রয়েছে। শুরুতে সুগন্ধিময় কবিতার মতো করে আধা পৃষ্ঠামতো একটি প্রারম্ভিকা, একটি সম্পাদকীয়, একেবারে শেষের দিকে ছোট্ট একটি উৎসর্গপত্র এবং ১৬ জন লেখিকার মোট সতেরটি বড় রচনা।
 
সবগুলো রচনার গদ্যভঙ্গিই অপূর্ব, পরিণত, ঝরঝরে, নিটোল এবং অবশ্যই আবেগমুক্ত নয়। ইতিহাসের তথ্যকে আবেগের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করার জটিল কাজটিতে সবাই উৎরে গেছেন অনায়াসে। তথ্যেরা এখানে ইতিহাসের আকড়গ্রন্থগুলো থেকে শুধু তথ্য হয়ে নেমে আসেনি; এসেছে বোধ ও উপলব্ধির ভেতর দিয়ে, স্বপ্ন ও কাতরতার স্পর্শ নিয়ে, সমাজ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একটি দায়বদ্ধতা থেকে একান্ত মানবিক হয়ে।

ফলে এ গল্পগুলো আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে। আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় আত্মজিজ্ঞাসার নির্মম এক পারদের সামনে। যার ফল হয়েছে এই, এ লেখাগুলোতে আমি ইতিহাসের সত্যকে পাঠ করেছি গল্পের ছলে এবং গল্পকে পাঠ করেছি ইতিহাসের সত্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে। এ উপলব্ধিটি আমাকে আনন্দিত করেছে, শিহরণ জাগিয়েছে। সাহিত্যাঙ্গনে এ জিনিসের চর্চা হওয়া একান্ত দরকার।

শুরুতে বলা চমকে উঠার কারণটি এবার বলি- 
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আমি মনে করি, গুরুত্বের সঙ্গে সত্যিকারের একটি নারী জাগরণ আন্দোলনের একান্ত প্রয়োজন। এ প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। কারণ, ইসলামি শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে সমাজে নারীরা নিগৃহীত হচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু নানা কারণে এ কাজটি সেভাবে হয়ে উঠছে না। এ সুযোগটি নিয়েছে বিকারগ্রস্ত ও চিন্তাভ্রষ্ট কিছু মানুষ। তারা নারীকে মুক্তির নাম দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেবল ভোগের দিকে। ভয়াবহ ও অশান্ত এক জীবনের দিকে।

এসব সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ধার্মিক ও পর্দানশীন পরিবারগুলো নিজেদের মেয়েদেরকে আরও গুটিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষার ব্যাপারেও দেখা দিয়েছে এক ধরণের অনীহা ভাব। মনে রাখতে হবে, নারীর ওপর এই সামাজিক নিগ্রহ, আবার এ থেকে মুক্তির জন্য প্রগতির ভাড়াটে শ্লোগানে তথাকথিত নারী জাগরণ হলো- এক ধরণের থিকথিকে অসুস্থতা।  

আমাদের উচিত হলো, কথিত নারী জাগরণের খোলস থেকে নারীদের সত্যিকারার্থে মুক্তি দেওয়া, অক্ষমতা ও অপারগতার অচলায়তন ভেঙ্গে নারীকে বের করে ইসলামসম্মত স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে নিয়ে আসা। এ জন্য সময় ও স্থান অনুযায়ী যা যা দরকার সবকিছুর জন্য নারীদের প্রস্তুত করে তোলা। যেন একজন নারীও পরাজিত না হয়- কথিত জাগরণের বিষ-ছোঁয়ায় একটি নারীও জীবনের স্নিগ্ধতা থেকে বঞ্চিত না হয়।

আশার কথা হলো, এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। ফলে দেখি অন্য সময়ের তুলনায় বর্তমানে নারীদের শিক্ষার পাটাতনটি দিন দিন মজবুত হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে। নারীরা জাগছেন। আর এ জাগরণের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হলো- ‘অপরাজিতা’।

অপরাজিতাদের তেজস্বী ও বিনয়ী এই আন্দোলনকে সময়ের বিপ্লবী ইশতেহার বলা চলে। অন্তত সম্পাদকীয়র শেষাংশটুকুকে আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মেয়েদের ব্যবস্থাপনা ও মেয়েদের লেখা নিয়ে প্রচলিত বৃত্তের বাইরে অপরাজিতা পরাজয় না মানার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে দূর-বহুদূর...। ’

‘অপরাজিতা’ একদিকে যেমন কথিত নারী জাগরণ ও প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক দেয়াল তৈরি করছে, অপরদিকে আমাদের অচলায়তনের ভেতরে একটি বিনয়ী ‘না’-কে মূর্ত করে তুলছে কৌশলে, ভালোবাসায় এবং শক্ত গাঁথুনিতে।

তাই, ‘অপরাজিতা’ আমাকে আশান্বিত করেছে। কারণ, অপরাজিতা সুন্দর এবং তা অভূতপূর্ব।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।