তবে হজের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজের তাৎপর্যের সঙ্গে। আর হজের এ তাৎপর্য হজের নিম্ন বর্ণিত আচার-অনুষ্ঠানসমূহ থেকে অনুধাবন করা সম্ভব।
১. ইহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজের সফরে রওয়ানা হওয়া, কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
২. হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজনয়ীতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩. ইহরাম পরিধান করে পূত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেওয়ার জন্য ‘লাব্বাইক’ বলা সমস্ত গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে।
৪. ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে বান্দা হজ বিষয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয় এবং বাধাবিঘ্ন, বিপদ-আপদ, কষ্ট-যাতনা পেরিয়ে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে- এ কথা ব্যক্ত করে।
৫. ইহরাম অবস্থায় সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে, মুমিনের জীবন বল্গাহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর হুকুম মানতে সদা প্রস্তুত। আল্লাহ যখন যা বলবেন, তা পালনে সদা প্রস্তুত। বান্দা আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বৈধ এমনকি অতি প্রয়োজনীয় জিনিসকেও ছেড়ে দিতে সে ইতস্তত বোধ করে না বিন্দুমাত্র।
৬. ইহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মুমিন ঝগড়াটে মেজাজের হয় না। মুমিন ক্ষমা ও ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। মুমিন শান্তিপ্রিয়। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সে পবিত্র ও সহনশীল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
৭. বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে। কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহতায়ালা। সফরের কষ্ট-যাতনা সহ্য করে বায়তুল্লাহর আশ্রয়ে গিয়ে মুমিন অনুভব করে এক অকল্পিত নিরাপত্তা। তদ্রুপভাবে শিরকমুক্ত ঈমানি জীবযাপনের দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনার পর মুমিন আল্লাহর কাছে গিয়ে যে নিরাপত্তা পাবে তার প্রাথমিক উদাহরণ এটি।
৮. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন বা স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ম্য কী তা আমাদের বুঝের বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন। এ চুম্বন বিনাশর্তে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যে নিজেকে আরোপিত করার একটি আলামত। এভাবেই মুসলমান যুক্তির পেছনে না ঘুরে, আল্লাহ ও রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের চেতনা শেখায় জীবন সপে দেয়।
৯. তাওয়াফ আল্লাহকেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়। অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এক আল্লাহকে সকল কাজের কেন্দ্র বানিয়ে যাপিত হয় মুমিনের সমগ্র জীবন। অর্থাৎ মুমিনের শরীর ও আত্মা, অন্তর-বহির সমগ্রটাই ঘোরে একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে যা পবিত্র কোরআনে ‘পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০. আল্লাহতায়ালা নারীকে করেছেন সম্মানিত। সাফা-মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত কামনায় একজন নারীর সীমাহীন দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে শ্রমের পর প্রবাহ পেয়েছিল রহমতের ফোয়ারা ‘জমজম। ’ সাত চক্করে সম্পূর্ণ করতে হয় সাঈ যা, স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর রহমত-সাহায্য পেতে হলে সাত চক্কর অর্থাৎ প্রচুর চেষ্টা মেহনতের প্রয়োজন রয়েছে। মা হাজেরার মতো গুটি গুটি পাথর বিছানো পথে সাফা থেকে মারওয়া, মারওয়া থেকে সাফায় দৌড় ঝাঁপের প্রয়োজন আছে। পাথুরে পথে সাত চক্কর, তথা প্রচুর মেহনত ব্যতীত দুনিয়া-আখেরাতের কোনো কিছুই লাভ হওয়ার নয়।
১১. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান আপনাকে কিয়ামতের মাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুণতে হবে অপেক্ষার প্রহর। সঠিক ঈমান ও আমলের অধিকারী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে আল্লাহর করুণায়। আর ঈমানহীন কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ঈমান-আমলওয়ালারা অনন্ত আজাব ভোগ করবে জাহান্নামে।
১২. হজ হচ্ছে ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও মুসলিম উম্মার ঐক্যের এক বাস্তব নিদর্শন। যার ফলে হজের সময় পবিত্র নগরী বাইতুল্লাহ ও মদিনায় বিলিন হয়ে যায় জাতি, রঙ, ভাষা, দেশ ও শ্রেণির উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ। প্রকাশ পায় ভ্রাতৃত্ব ও আনুগত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। রাজা-প্রজা সকলকেই একই রঙের পোশাক পরে একই কিবলামুখি হয়ে একই আল্লাহর ইবাদত করে।
১৩. হজ এমন একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, যেখান থেকে সকলে ধৈর্যের বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরকালীন জিন্দেগির ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যার ফলে দুই টুকরো সাদা কাপড়ে আবৃত বনি আদম ইবাদত-বন্দেগিতে অনন্য স্বাদ অনুভব করে। হজের দৃশ্য দেখে অনুভূত হয় তার প্রতিপালকের মহত্ব।
১৪. হজের মৌসুম নেকি উপার্জনের এক বিরাট সুযোগ। এ সময় সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়, পাপরাজি মাফ করে দেওয়া হয়। বান্দা প্রতিপালকের সামনে দাঁড়িয়ে তার একত্ববাদকে নিঃসংকোচে মেনে নেয়। তার বিধি-বিধান পালনে সকল অপারগতাকে স্বীকার করে নেয়। যার ফলে হজপালকারীরা ওই দিনের নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে ফিরে আসে, যে দিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল।
১৫. হজ মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় দুনিয়াতে নবি-রাসূলদের একত্ববাদের দাওয়াতি মিশনের কথা। তাদের ইবাদত-বন্দেগির কথা; আরও স্মরণ হয় তাদের দাওয়াত ও জিহাদ এবং মহান চরিত্রের কথা। হজ মানুষকে পরকালের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে। অর্থাৎ হজের সফর মানুষকে পরকালীন জীবনের প্রস্তুতিতে সহযোগিতা করে, যে সফরে থাকবে না কোনো সন্তান-সন্তুতি, স্ত্রী ও আপনজন।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৭
এমএইউ/