ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

অর্থবিত্ত ও পদমর্যাদার গৌরব ভুলে ইহরাম বাঁধতে হয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
অর্থবিত্ত ও পদমর্যাদার গৌরব ভুলে ইহরাম বাঁধতে হয় অর্থবিত্ত ও পদমর্যাদার গৌরব ভুলে ইহরাম বাঁধতে হয়

হজের তিনটি ফরজের মধ্যে ইহরাম বাঁধা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। ইহরাম অর্থ কোনো বস্তু বা কর্মকে নিজের জন্য হারাম করে দেওয়া।

ওমরা বা হজ গমনেচ্ছুক ব্যক্তি ইহরামের মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় নিজের ওপর হারাম করে দেয় যা স্বাভাবিক অবস্থায় তার জন্য হালাল ছিলো।  

সুনির্দিষ্ট কতগুলো মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়।

দৈনন্দিন ব্যবহৃত সব কাপড় ছেড়ে দিয়ে সেলাইহীন সাদা চাদর ও একটি সেলাইহীন লুঙ্গি পরিধান করা। দৈনন্দিন ব্যবহার্য তথা আড়ম্ভরপূর্ণ সব কাজ পরিত্যাগ করে ভিক্ষুকের মতো আল্লাহর দরবারে হাজির দেওয়া। যেমন- কোনো প্রকার সুগন্ধি, আতর, তৈল ও সাবান ব্যবহার না করা, আচকান, জামা, পায়জামা, পেন্ট, গেঞ্জি ইত্যাদি কোনো ধরনের সেলাই করা পোশাক ও পা ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান না করা।  

ইহরাম বাঁধার পর শরীরের কোনো অংশের লোম বা চুল, নখ কর্তন না করা, স্ত্রী সঙ্গম, আলিঙ্গন, চুমু বা শৃঙ্গার জাতীয় কথা বা আচরণ না করা, শিকার না করা বা শিকারে সাহায্য না করা, কোনো প্রকার পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ এমনকি নিজের শরীরে অবস্থানকারী উকুন বা মশা না মারা। অশ্লীল কথাবার্তা, ঝগড়া-বিবাদ না করা।

ধনী-দরিদ্র, বাদশা-ফকির, কালো-ধলা, উত্তম-অধম ভেদাভেদহীন ও বর্ণ-বৈষম্যহীন একই পোশাকে সেই মহান প্রভুর দরবারে ধরনা দেওয়ার এক মহাসম্মিলন, যেই প্রভু কারো প্রভাব-প্রতিপত্তি বা বিশেষ কোনো মর্যাদার আলোকে বিচার করেন না। বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য সেখানে বিশেষ কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। দেশে তিনি নরম বিছানা ব্যবহার করেন বটে কিন্তু মুজদালিফায় বিশাল খোলা আকাশের নিচে, বালুকণা ও পাথরের টুকরাযুক্ত মাঠে সারারাত থাকতে হবে। এখানে ভুলে যেতে হবে নিজের অর্থবিত্ত ভৈবব ও পদমর্যাদার গৌরব।  

ধনী-গরিব মিলে-মিশে সবাই একসাথে একাকার হয়ে যাবেন শুধু একটি আশায়, তা হলো মহান রবের রহমত, করুণা ও ক্ষমা। সবাই সমস্বরে বলবে, ‘হে আল্লাহ আমি হাজির! আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই। আমি হাজির এটা নিশ্চিত যে তোমারই সব প্রশংসা, সব নিয়ামত ও বাদশাহী। তোমার কোনো অংশীদার নেই। ’

মিকাত হলো- মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরের কাছে পৌঁছার আগে এমন কতগুলো সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে যেগুলো আল্লাহর ঘর তথা আল্লাহর সম্মান, ইজ্জত ও বুজর্গির সীমানা।

সুতরাং এই পয়েন্টগুলো অতিক্রম করার আগে আল্লাহর ঘর তথা আল্লাহর সম্মানে দুনিয়ার সব প্রকার আভিজাত্য, বিশেষ কোনো মর্যাদা, দুর্দণ্ড প্রতাপ-প্রতিপত্তি পেছনে ঠেলে একমাত্র আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব, তার শান-শওকত ও রাজাধিরাজ, আজিজ ও কাদির এবং ব্যক্তি নিজে একজন সামান্যই দীন ভিক্ষুকের মতো এলোকেশে ধুলোমলিন বদনে, যেন কারো জন্য পাগল প্রায় অবস্থায় এই চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করবো।  

হাদিসে পাওয়া যায়, ‘জমিনবাসীদের নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সাথে গৌরব করে বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ তারা ধুলোমলিন অবস্থায় এলোকেশে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে আমার রহমতের আশায়, অথচ আমার আজাব তারা দেখেনি। কাজেই আরাফার দিনে এত অধিকসংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে আমি মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি যা অন্য দিন তারা পায়নি। ’

পাঁচটি মিকাত মূলতঃ আল্লাহর ঘরের সম্মানের চৌহদ্দি। এই চৌহদ্দিতে প্রবেশ করার পর মনে করতে হবে আপনিই পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল প্রাণী। কাউকে মারা তো দূরের কথা কাউকে আঘাত করার ক্ষমতাও আপনার নেই। আপনি দুনিয়ার সবচেয়ে দামি পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করার ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু তার দরবারে হাজিরার জন্য আপনাকে এই সামান্য মূল্যমানের একই ধরনের একই রঙের পোশাক পরতে হবে। আর এ পয়েন্ট অতিক্রম করার পর আপনাকে মানুষ তো দূরের কথা একটি ছোট্ট প্রাণীকে সামান্যতম আঘাত করার ক্ষমতাও আপনি রাখেন না।

ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। হজ ও ওমরা পালনকারী প্রত্যেকে অবশ্যই ইহরাম পরে কেবলই মিকাত অতিক্রম করতে পারবেন। কাবার চারদিকে একটা নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে মিকাতগুলো নির্ধারণ করে গেছেন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)। মিকাতগুলো হলো-

১. জুল হুলাইফা: এ স্থানটি এখন ‘আবইয়ারে আলি’ নামে পরিচিত। এটি মক্কা শহর থেকে ৪২০ কিলোমিটার এবং মসজিদে নববী থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মদিনাবাসী এবং এ পথ দিয়ে যারা আসে তারা এখান থেকে ইহরাম বাঁধবেন।

২. জুহফা: এটি লোহিত সাগর থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে রাবেগ শহরের কাছে। জুহফাতে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাবেগ থেকে এখন লোকেরা ইহরাম বাঁধেন। জম্মুম উপত্যকার পথ ধরে মক্কা শহর থেকে এটি ১৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, ফিলিস্তিন, মিসর, সুদান, মরকক্কো, আফ্রিকার দেশগুলো ও আরবের উত্তরাঞ্চলীয় কিছু এলাকার লোকেরা এখান থেকে ইহরাম বাঁধেন।

৩. কারনুল মানাজিল স্থানটি এখন ‘সাইলুল কাবির’ নামে প্রসিদ্ধ। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার। রিয়াদ, দাম্মাম, তায়েফ, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, ইরানসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এ পথ দিয়ে আসে।
৪. ইয়ালামলাম একটি উপত্যকার নাম বলে জানা যায়। এটি মক্কা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এলাকাটি সাদিয়া নামেও পরিচিত। ইয়েমেন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের মিকাত এটি।

৫. জাতুইরাক মক্কা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইরাকবাসীর মিকাত এটি।  

আগেই বলেছি এই মিকাতগুলো মূলত আল্লাহর ঘর তথা খানায়ে কাবার সম্মানের চৌহদ্দি। সুতরাং এই চৌহদ্দি অতিক্রম করে মহান রবের দরবারের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর আগেই নিজেকে সামলে নেওয়া বা থমকে যাওয়া। এই থমকে যাওয়ার নাম হলো ইহরাম অর্থাৎ নিজের সব ধরনের আভিজাত্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, দৈনন্দিন অভ্যাস বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভালো হোক বা মন্দ এগুলো নিজের ওপর এই চৌহদ্দির আগেই ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বা হারাম করে তবেই কেবল নির্ধারিত পোশাকে তা অতিক্রম করা যাবে। এই সম্মান এতটাই স্পর্শকাতর যে কেউ যদি ভুলক্রমে তা অতিক্রম করে ফেলে, ইসলামি চিন্তাবিদরা বলেছেন, ফিরে এসে নতুন করে ইহরাম বেঁধে পুনরায় প্রবেশ করবেন।

প্রকৃতপক্ষে হজ, কোরবানি ও খানায়ে কাবার কথা উচ্চারিত হলেই যেই নামটি খুব দ্রুত হৃদয়ের আয়নায় ভেসে আসে, তিনি হলেন- হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। পিতা-পুত্র মিলে কাবা পুনর্নির্মাণ করেছিলেন।  

বায়তুল্লাহ নির্মাণের প্রক্কালে হজরত ইবরাহিম (আ.) তার ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে সাথে নিয়ে যে দোয়াগুলো করেছিলেন- তন্মধ্যে একটি দোয়ার তাৎপর্য সম্মানিত হজযাত্রীদের অনুধাবন করার অনুরোধ করছি।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন ইবরাহিম দোয়া করেছিল, হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপত্তার শহরে পরিণত করো এবং আমার ও আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে বাঁচাও। হে আমার রব! এ মূর্তিগুলো অনেককে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, (হয়তো আমার সন্তানদেরও এরা পথভ্রষ্ট করতে পারে, তাই তাদের মধ্য থেকে) যে আমার পথে চলবে সে আমার অন্তরগত আর যে আমার বিপরীত পথ অবলম্বন করবে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যি তুমি ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।

হে আমার রব! আমি একটি তৃর্ণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামাজ কায়েম করবে। কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো, হয়তো এরা শোকরগুজার হবে।

হে পরওয়ারদিগার! তুমি জানো যা কিছু আমরা লুকাই এবং যা কিছু প্রকাশ করি। আর যথার্থই আল্লাহর কাছে কিছুই গোপন নেই, না পৃথিবীতে না আকাশে, শোকর সেই আল্লাহর, যিনি এ বৃদ্ধ বয়সে আমাকে ইসমাঈল ও ইসহাকের মতো পুত্র দিয়েছেন। আসলে আমার রব নিশ্চয়ই দোয়া শোনেন। হে আমার রব! আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী করো এবং আমার বংশধরদের থেকেও (এমন লোকদের উঠাও যারা এ কাজ করবে)।

পরওয়ারদিগার! আমার দোয়া কবুল করো। হে পরওয়ারদিগার! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো। ’ -সূরা ইবরাহিম: ৩৪-৪১

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।