তার আচরণ-ব্যবহার, স্বভাব-কথাবার্তা মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতো শত্রু-মিত্র সকলের মনে। এ কোমলতাকে সঙ্গে করেই তিনি কাটিয়েছেন পুরো জীবন।
কিন্তু যখন তিনি মদিনায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন দাওয়াত আর কেবল এই ঈমান-আকিদা বিষয়ে নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি ইসলামের বিধান মানুষকে শিখিয়েছেন। দ্বীনি বিষয় হোক, আর দুনিয়াবি বিষয়ই হোক, সর্বত্রই তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে তার অনুসারীদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন। সেই দাওয়াতে ফুঁটে উঠত তার প্রজ্ঞা, কোমলতা, আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা ও দয়া ইত্যাদি যাবতীয় মহৎ গুণ। মহান আল্লাহর নির্দেশনাও ছিলো এমন- তুমি তোমার প্রভুর পথে আহ্বান করো হিকমত ও প্রজ্ঞা এবং সদুপদেশের মাধ্যমে, আর কখনও যদি তর্কের প্রয়োজন হয় তাহলে উত্তম পন্থায় তর্ক করবে। -সূরা নাহল: ১২৫
নবী করিম (সা.) একবার মসজিদে নববীতে বসে আছেন। সঙ্গে তার কয়েকজন সাহাবি। এমন সময় এক গ্রাম্য লোক এসে মসজিদে প্রস্রাব করতে শুরু করলো। তখন উপস্থিত সাহাবারা তাকে পাকড়াও করার জন্যে তেড়ে গেলেন। কিন্তু হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বললেন, তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাবের ওপর এক বালতি পানি এনে ঢেলে দাও। তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে বিষয়াদি সহজ করার জন্যে, কঠিন করার জন্যে নয়। -সহিহ বোখারি: ৬১২৮
সাহাবায়ে কেরাম মসজিদ পবিত্র রাখতে গিয়ে এবং মন্দ কাজে বাধা দিতে আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টি ছিল আরও দূরে। তিনি বিষয়টির শেষ পরিণাম কী হতে পারে সেদিকে লক্ষ করছিলেন। তিনি দেখলেন, এতে দুই রকম আচরণ করা যেতে পারে- তাকে প্রস্রাব করতে বাধা দেওয়া কিংবা প্রস্রাব করার সুযোগ দেওয়া। বাধা দেওয়া হলে হয়তো সে তার প্রস্রাব তাৎক্ষণিক আটকে রাখবে, কিন্তু এতে তার শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। কিংবা প্রস্রাব আটকাতে না পেরে সে অন্যদের ভয়ে পালাতে শুরু করবে। তখন প্রস্রাবের অপবিত্রতা মসজিদের আরও অধিক জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। অপবিত্র হয়ে পড়বে তার শরীর এবং কাপড়ও। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাকে প্রস্রাব শেষ করতে দিলেই বরং ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়। এটি একটি ছোট ভুল হবে। বিশেষত এজন্যেও, লোকটি ভুল কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে এবং এর অপবিত্রতা পানি দিয়ে দূর করা সম্ভব। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদেরকে বলেছেন, তাকে ছেড়ে দাও, তাকে বাধা দিও না। এ পদ্ধতিটিই ছিলো অপেক্ষাকৃত অধিক কল্যাণকর। এর মধ্য দিয়ে ছোট অন্যায়কে মেনে নিয়ে বড় অন্যায়কে প্রতিহত করা হলো। ছোট কল্যাণকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে অর্জিত হলো বড় কল্যাণ।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ প্রজ্ঞা কোমলতা ও বিচক্ষণতাপূর্ণ আচরণ গ্রাম্য ব্যক্তিটির মনে যে কী গভীর রেখাপাত করেছিলো, তা পরবর্তীকালে তার নিজের কথাতেই ফুটে উঠেছে। নিজের এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এই সাহাবি বলেছেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্যে আমার মা-বাবা উৎসর্গিত, তিনি তখন আমার নিকট এলেন। কিন্তু আমাকে ধমকও দেননি, শাসিয়েও কিছু বলেননি, শুধু এইটুকু বললেন, এই মসজিদে তো প্রস্রাব করা যায় না, এটা বানানো হয়েছে আল্লাহতায়ালার জিকির ও নামাজ আদায়ের জন্য। এরপর তিনি এক বালতি পানি আনতে বললেন। তখন তা প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো। -সুনানে ইবনে মাজা: ৫২৯
সময়ের হিসেবে মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধান। এ সামান্য সময়েই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরব্য জাহিলিয়্যাতের যাবতীয় অন্ধকার দূর করে পুরো আরবজুড়ে ছড়িয়ে দিলেন ইসলামের ঝলমলে কিরণ। দাওয়াত পৌঁছে গেল আরবের বাইরের তৎকালীন পরাশক্তিদের নিকটও। স্বজাতির জুলুম-নির্যাতনে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে হিজরত করেছিলেন মদিনায়, ছেড়ে এসেছিলেন প্রাণপ্রিয় কাবা ঘর, জীবনের শেষলগ্নে সেই কাবাপ্রাঙ্গনে তিনি উপস্থিত লক্ষাধিক অনুসারীসহ। কিন্তু কী সেই রহস্য? এর উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে তার জীবনব্যাপী দাওয়াতের পথেই অগ্রসর হতে হবে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
এমএইউ/