বাস যাত্রী কাউকে বলে দিতে হলো না। মদিনা নগরের প্রবেশের সময় সবাই শিহরণ অনুভব করলেন।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালাম দেওয়ার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরআনে দিয়েছেন। ইরশাদ করা হয়েছে: “নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর প্রতি সালাত (রহমত) প্রেরণ করেন আর তার ফিরিশতাগণও নবীর প্রতি সালাত (দোয়া) পাঠান। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি সালাত (দরুদ) পাঠ কর এবং সালাম পাঠাও। (সুরা আহযাব : ৫৬)
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ মুমীন-মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য সাব্যস্ত হয়েছে। হাদিস শরিফে এই দরুদ ও সালামের বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
বাস থেকে সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট রওজা মোবারক চোখের সামনে দেখা যেতেই সবাই আবেগে উদ্বেলিত হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাম ও দরুদ শরিফ পেশ করতে থাকেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মদিনা শরিফে নিজে যে মসজিদটি নির্মাণ করেন নিজের বাসগৃহের পাশে, সেখানেই তিনি শায়িত রয়েছেন।
ইসলামের ইতিহাসভিত্তিক ভাষ্য অনুযায়ী, মদিনায় প্রবেশ করে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর উট যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হল মসজিদে নববীর কেন্দ্রস্থল। পবিত্র কাবা শরিফ মসজিদে হারামের পরেই মদিনা মসজিদের মর্যাদা ও অবস্থান। পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতির নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ মদিনায় সমবেত হয়ে নবীর প্রতি সালাম জানান। নবীর মসজিদ এখন বিশ্ব মুসলিমের মিলন ও ঐক্যের কেন্দ্রস্থল।
এখানে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, মহানবীর হিজরতের আগ পর্যন্ত মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব। হিজরতের পর জনপদের নাম হয় মদিনাতুন নবী, নবীর শহর। হিজরতের সঙ্গে সঙ্গে ৬২২ সালে সেখানে মুসলমানদের নামাজের জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কর্তৃক নির্মিত হয় মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করতে ৭ মাস সময় লেগেছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরের পর থেকে শুরু হয়ে ৬২৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মদিনা মসজিদের নির্মাণকাল নির্ধারণ করা হয়।
নবীর শহর মদিনার মসজিদের মাধ্যমে ইসলামী ঐতিহ্য ও শিল্পকলার প্রকাশ ঘটে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মদিনা মসজিদের নির্মাণের জন্য নাজ্জার গোত্রের সাহল ও সোহাইল নামক দু’জন বালকের নিকট হতে জমি ক্রয় করেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দশ দিনার মূল্যে স্থানটি খরিদ করেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করেন। অতঃপর তার আশপাশের কবরগুলো এবং বাড়ি-ঘরের ভগ্নস্তূপসহ স্থানটি সমতল করেন। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলো উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়। ঐ সময় ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা ছিল মদিনা হতে উত্তর দিকে।
তিনটি দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলো পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলো খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর ডালপাতার এবং বালু ও ছোট কাঁকর বিছানো মেঝে-এই নিয়ে তৈরি হল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৭ হাত আয়তন বিশিষ্ট। পরবর্তীতে মদিনা মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রতিটি কোণ হতে তীর নিক্ষেপ করে যে পরিমাণ জায়গা পাওয়া গেল তা হলো একটি ক্ষেত্র। বর্গের প্রতিটি বাহুর পরিমাণ হয় ১০০ হাত বা ৫৬ গজ। অর্থাৎ মদিনা মসজিদের আয়তন হল ১০০ বাই ১০০ হাত বা ৫৬ বই ৫৬ গজ।
ঐতিহাসিক ইবনে সাদ ও দিয়ার বকরী বলেন, মসজিদের ভিত্তি ও দেয়ালের নিম্নভাগ ৩ হাত পর্যন্ত প্রস্তর নির্মিত ছিল। প্রথম পর্যায়ে মদিনা মসজিদ রৌদ্র শুষ্ক ইট দ্বারা নির্মিত হয়। এই রৌদ্র শুষ্ক ইট বাকি আল-খাবখাবা উপত্যকা হতে আনিত কাদা দ্বারা তৈরি হয়েছিল। তখন মদিনা মসজিদের দেয়াল ছিল ৭ হাত উঁচু। ছাদকে শক্তিশালী ও মজবুত রাখার জন্য মদিনা মসজিদের ৩৬টি খেজুর গাছকে স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। মসজিদের ছাদ নির্মিত হয়েছিল খেজুর পাতা দিয়ে। ছাদকে সুন্দর করার জন্য, রৌদ্র ও বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য খেজুর পাতার ওপর কাদামাটির আস্তরণ দেয়া হয়েছিল।
হিজরতের ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হলে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। কেননা মক্কা হল মদিনা থেকে দক্ষিণ দিকে। এ সময় উত্তর দেওয়ালের বাইরে একটা খেজুর পাতার ছাপড়া দেওয়া হয়। আরবীতে বারান্দা বা চাতালকে ‘ছুফফাহ’ বলা হয়। ওই ছুফফাহ’তে নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় মুসলমানদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া হত। পরবর্তীতে তাদের কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা চলে যেতেন। বারান্দায় বা চাতালে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীরা ইতিহাসে ‘আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেছেন।
মসজিদ নির্মাণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজ হাতে ইট ও পাথর বহন করেন। এ সময় তিনি সাথীদের উৎসাহিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের আরাম ব্যতীত কোন আরাম নেই’। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’।
রাসুলের নিজ হাতে কাজ করায় উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীরা গেয়ে ওঠেন- ‘যদি আমরা বসে থাকি, আর নবী কাজ করেন, তবে সেটা আমাদের পক্ষ থেকে হবে নিতান্তই ভ্রষ্ট আমল’।
সে সময় মদিনা মসজিদের প্রবেশের জন্য ৩টি দরজা ছিল। প্রধান প্রবেশ পথটি ছিল দক্ষিণ দিকে। এটি দিয়ে মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করত এবং বের হত। পশ্চিম দেয়ালে ছিল মসজিদের দ্বিতীয় প্রবেশ পথ। এটি বাবে রহমত নামে পরিচিত তৃতীয় প্রবেশ পথটি পূর্ব দেয়ালে ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এটি দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। এজন্য এটির নাম হয় বাব উন নবী। মসজিদের দরজা প্রস্তর নির্মিত ছিল।
বর্তমানে মদিনা মসজিদ আগের চেয়ে অনেক সম্প্রসারিত ও নতুন ডিজাইনের দ্বারা সজ্জিত। প্রাচীন মদিনা মসজিদের পার্শ্বেই ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বাসগৃহ। মক্কা হিজরতকারীদের বাসস্থান এবং মদিনারও স্থায়ীবাসী আনসারদের আবাসও ছিল পাশেই।
মক্কা হতে মদিনায় হিজরতের ঘটনায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও পৃথিবীর মানচিত্রে ‘মদিনা’ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ স্বাধীন মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি মসজিদে নববী হতেই ইসলাম প্রচার, রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। মদিনায় হিজরত থেকে হিজরি সাল বা বছর গণনা শুরু হয়।
জেনে রাখা প্রয়োজন, মদিনা সনদ হল বিশ্বের ইতিহাসে লিখিত সর্বপ্রথম সংবিধান। মহানবী হযরত মুহাম্মদকে (স.) এখানেই সমাহিত করা হয়। মদিনায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজা হওয়ায় সকল মুসলমানের নিকট মদিনা মসজিদ পবিত্র ও সম্মানিত।
একমাত্র মদিনা মসজিদেই সর্বপ্রথম মেহরাব, মিম্বার, আজান দেয়ার স্থান নির্মিত হয়। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের কাছে পবিত্র আধ্যাত্মিক নগরী হিসাবে মদিনার মর্যাদা ও সম্মান নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান ও উপস্থিতির কারণে চির সমুজ্জল। বিশ্ব মুসলিমের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চির জাগ্রত নবীর মসজিদ, নবীর শহর, মদিনা।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৭
এমপি/জেডএম