ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ইসলামে স্বাধীনতা ও নাগরিক দায়বোধ

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
ইসলামে স্বাধীনতা ও নাগরিক দায়বোধ ইসলাম মতে মানুষের জন্মগত অধিকার হচ্ছে স্বাধীনতা ভোগের অধিকার

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেছেন, ‘পৃথিবীর বুকে তুমি মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছো, অথচ তার মা তাকে স্বাধীন মানুষরূপেই জন্ম দিয়েছেন।’

বস্তুত আল্লাহতায়ালা মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন এবং এই স্বাধীনতা নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং তার জন্মগত অধিকার হচ্ছে কেউ তাকে তার এই স্বাধীনতা ভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না এবং জোর-জবরদস্তি তাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করবে না।  

ইসলাম যখন স্বাধীনতাকে তার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে, তখন সময়টি ছিল এমন যে; অধিকাংশ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিকভাবে আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল।

মানুষের এই বহুরূপ দাসত্ব-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ইসলাম স্বাধীনতা ঘোষণা করল। বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতা সব ক্ষেত্রেই ইসলাম এই স্বাধীনতা দিয়েছে। আর চিরকাল ধরে এসব বিষয়েই মানুষ তাদের স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে আসছে।  

ইসলাম স্বয়ং একটি ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম বা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দমননীতি অনুমোদন করে না। কোরআনে কারিমে আমরা এই বিস্ময়কর প্রকাশ দেখতে পাই। যেখানে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধর্মের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই। মিথ্যা থেকে সত্যকে যথার্থভাবেই পৃথক করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। ’ -সূরা আল বাকারা: ২৫৬

এই আয়াতের তাৎপর্য এখানে যে, ইসলাম স্বাধীনতাকে কতটা পবিত্র করেছে এবং একে কতটা মর্যাদা দিয়েছে তা এ আয়াতে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে।  

দ্বিতীয় স্বাধীনতা হচ্ছে চিন্তা ও গবেষণার স্বাধীনতা। ইসলাম তার অভ্যুদয়কাল থেকেই সমগ্র বিশ্বজগত সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কোরআনে কারিমের একাধিক আয়াতে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে। ওইসব আয়াতে অলিক কল্পনা, বদ্ধমূল ধারণা ও আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণকে নিন্দা করা হয়েছে। যারা নিজেদের মনগড়া ধারণা কিংবা পূর্ব-পুরুষ ও কর্তাব্যক্তিদের অন্ধ অনুসরণ করে তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। ইসলামের অবস্থান হচ্ছে, সব সময় মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও গভীর চিন্তা-ভাবনার পক্ষে। ইসলাম সর্বদা অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেয়।  

ইসলাম তার ধর্ম-বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণের জন্য সব সময় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। এ কারণে মুসলিম মনীষীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যথার্থ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই ধর্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যিকার সম্পর্কের ভিত রচিত হয়।  

মানুষের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম কথা বলার ও সমালোচনার স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র মূলনীতি হিসেবেই গ্রহণ করেনি কিংবা একে স্বাধীনতার অংশ হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছে। সমাজ-সংস্কৃতি ও গণমানুষের স্বার্থ, সার্বজনীন নৈতিকতা ও জীবন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত জনগুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে সত্য বলা, সত্য প্রকাশ এবং সমালোচনাকে আইনগত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হক কথা বলা, সমালোচনা করা, সং কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করাকে ধর্মীয় কর্তব্যেরও অংশ বলে গণ্য করা হয়েছে। সত্যের প্রতি আহ্বান, সৎ লোকদের উৎসাহ প্রদান, দুষ্কৃতিকারীদের নিন্দা করাকে ঈমানদারীর লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।  

ইসলাম মনে করে, ঈমানদার ব্যক্তির নীরবতা যদি সমাজের ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে এর জন্য আল্লাহর কাছে তাকেও জবাবদিহি করতে হবে। এ কারণে ঈমানদার ব্যক্তির ওপর অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে সত্যের পক্ষে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসা এবং এক্ষেত্রে কোনো রক্তচক্ষুর হুমকি বা কোনো পরিণতির পরোয়া না করে সত্যকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া।  

ইসলাম মুসলমানদের বিশ্বাসের দৃঢ়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করারও নির্দেশ দেয়। এমনকি ধর্ম বিশ্বাসকে লালন করার ক্ষেত্রে যদি জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাহলে তাও করতে হবে এবং জুলুম মোকাবিলায় প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণেরও অনুমোদন দেয়, যাতে সমস্ত বাধা অপসারিত হয় এবং আনুগত্য কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হয়।  

পাঠক মাত্রেই একথা জানেন যে, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিনের একটি লালিত বিষয়। এই স্বাধীনতার লক্ষে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে। ইসলামের সোনালী আইন হচ্ছে- নিজের এবং অন্য কারও ক্ষতি করা যাবে না। পাকিস্তানি শাসকরা এ কথা ভুলে- আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চিত করেছে।  

এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং আপামর বাঙালি জনতা পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।

মহান স্বাধীনতা দিবসে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। সেই সঙ্গে সুনাগরিক হিসেবে প্রত্যেকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলবেন সেই প্রত্যাশা রাখি।  

মনে রাখতে হবে, আপনার স্বাধীনতার সমাপন অন্যের স্বাধীনতার সূচনা করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, রাস্তায় চলাচল কিংবা গাড়ি চালানোর অধিকার আপনার রয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে শর্ত হচ্ছে, আপনাকে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাহলে স্বাধীনতার অজুহাতে আপনার দ্বারা পথচারীকে চাপা দেওয়া, অন্যের গাড়ির ক্ষতি করা কিংবা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা সম্ভব হবে না।  

এই দৃষ্টান্তটি ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানব কল্যাণে প্রত্যেক ধর্মেই এবং প্রত্যেক ব্যবস্থাতেই কিছু বিধি-নিষেধ এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে। ইসলামও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। এটাকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার অন্তরায় বলা বা মনে করা ঠিক না। বরং এখানেই নিহিত স্বাধীনতার তাৎপর্য।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।