ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

হজ ব্যবস্থাপনাকে অস্থিতিশীল করছে মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, সিনিয়র বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৮
হজ ব্যবস্থাপনাকে অস্থিতিশীল করছে মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা সম্প্রতি আকবর হজ গ্রুপ বাংলাদেশের ব্যানারে নামে-বেনামে প্রায় ১৪টি হজ এজেন্সিসহ বেশ কয়েকটি এজেন্সির মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে হজযাত্রীদের নিবন্ধন না করে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে

‘প্রতিবছর হজের মৌসুমে আল্লাহর ঘরের মেহমান হাজীদের বিড়ম্বনার যে চিত্র ফুটে উঠে তাতে লজ্জিত হতে হয়। ধর্মীয় আচার-আচরণের মতো একটি ক্ষেত্রে এক মুসলমান আরেকজনের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করতে না চাইলেও তা মানতে হয়, দেখতে হয়। এটা ভীষণ কষ্টের।’

এভাবেই হজযাত্রীদের নিয়ে প্রতারণার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন উত্তরার মুহাম্মদ তাসনীম।

চলতি বছর হজের নিয়তে তিনি প্রাক-নিবন্ধন করে চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য এক গ্রুপ লিডারকে টাকা দিয়েছেন।

কিন্তু এজেন্সির মালিক তার মতো অনেকেরই চূড়ান্ত নিবন্ধন করেননি। টাকা নিয়ে তিনি পালিয়েছেন। মুহাম্মদ তাসনীম এখনও জানেন না, তিনি হজব্রত পালন করতে পারবেন কিনা।  

তিনি বলেন, ‘হাজীদের সেবা প্রদানকারী এজেন্সির মালিকদের ঘৃণ্য লোভী মনোভাব ও প্রতারণার দরুণ তাদের মুসলিম বলতে ঘৃণা হয়। যদিও তাদের বেশিরভাগই ধার্মিক সর্বোপরি মুসলিম। হজসেবার ঠিকাদার কতিপয় ঘৃণ্য অপরাধী বার বার সহজ-সরল হাজীদের প্রতারিত করে চলছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। ’

শুধু মুহাম্মদ তাসনীমের নয়, অনেক হজ গমনেচ্ছুর এমন বিড়ম্বনার চিত্র নতুন নয়। এটা থামানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। এবার হজ ব্যবস্থাপনার শুরুতেই চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। সরকারের কঠোর শাস্তি ও হুঁশিয়ারিতেও কাজ হলো না।  

সম্প্রতি আকবর হজ গ্রুপ বাংলাদেশের ব্যানারে নামে-বেনামে প্রায় ১৪টি হজ এজেন্সিসহ বেশ কয়েকটি এজেন্সির মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে হজযাত্রীদের নিবন্ধন না করে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন প্রায় দুই হাজার হজযাত্রী। প্রাক-নিবন্ধন থাকার পরও প্রায় দুই হাজার হজযাত্রী চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে পারেননি।

প্রাক-নিবন্ধিত এসব হজযাত্রীর চূড়ান্ত নিবন্ধন না হওয়ায় কোটার বাইরে পড়ে গেছেন তারা। হজনীতি অনুযায়ী এসব যাত্রীর আর এবার হজে যাওয়ার সুযোগ নেই। লাপাত্তা হওয়া এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে সরকার ঘোষিত সর্বনিম্ন হজ প্যাকেজের চেয়ে কম টাকায় হজ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে হজযাত্রী সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে।  

এ ঘটনার পর সাধারণ হজযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ৫ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ হজযাত্রীরা। একই দাবীতে তারা প্রধানমন্ত্রীর দফতর, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের পরিচালকের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।  

‘আকবর হজ গ্রুপ কর্তৃক প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদ’র ব্যানারে আয়োজিত মানবববন্ধনে পরিষদের সভাপতি আবদুর রকিব বলেন, চূড়ান্ত নিবন্ধন শুরুর আগে আকবর হজ গ্রুপকে হাজী প্রতি এক লাখ ৮১ হাজার ৭৫২ টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত নিবন্ধনের শেষদিন গত ১ এপ্রিল আকবর হজ গ্রুপের পল্টনের অফিসে গেলে অফিস তালাবদ্ধ পাই। তাদের দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রুপের চেয়ারম্যান মুফতি লুৎফর রহমান ফারুকীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তার স্ত্রীকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না।  

বেশ কয়েকজন হজ এজেন্সি মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বেসরকারি হজযাত্রী মধ্যস্বত্বভোগী গ্রুপ লিডারদের মাধ্যমে এজেন্সিতে বুকিং দেয়। হাবের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন প্যাকেজ তিন লাখ ৩২ হাজার ৮৬৮ টাকা নির্ধারণ করলেও এক লাখ ৩৮ হাজার ১৯১ টাকা দিয়ে নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা এজেন্সি মালিককে কিছু টাকা বা পুরো দিয়ে হজযাত্রীদের নিবন্ধন করে নিচ্ছেন। হাজী পেতে এজেন্সির পক্ষ থেকে গ্রুপ লিডারদের এমন ছাড় দেওয়ার প্রচলন ওপেন সিক্রেট। এ ব্যবস্থায় যেহেতু সরাসরি হজযাত্রী ও হজ এজেন্সির মধ্যে কোনো যোগাযোগ থাকে না। ফলে মধ্যস্বত্বভোগী গ্রুপ লিডার কিংবা এজেন্সির মালিক প্রতারণা করার সুযোগ পান। যদিও সরকার হজ ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের রুখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

আমরা মনে করি, হজযাত্রী নিবন্ধনে সরকারি-বেসরকারি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থার দরুণ দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজের পুরো টাকা একসঙ্গে জমা নেওয়ার বিধান থাকলেও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অর্ধেকের কম নিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হচ্ছে। এ সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য চলছে। হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণার সুযোগ পাচ্ছে দালালরা। যার প্রভাব পড়ছে পুরো হজ ব্যবস্থাপনার ওপর।  

মূলত প্রাক-নিবন্ধনের পর মধ্যস্বত্বভোগীরা হজযাত্রীদের কাছ থেকে বাকি টাকা নিলেও এর পুরো টাকা এজেন্সি মালিককে দেন না। এ জন্য এজেন্সি মালিকও সেবা দিতে গড়িমসি করেন। এবার তো টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়ার ঘটনাই ঘটল।

প্রশ্ন হলো, হজযাত্রীদের সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল কিংবা এজেন্সির মালিকরা এমন প্রতারণার সুযোগ পায় কীভাবে? এ বিষয়ে আগে খোঁজ নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।  

এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, কম টাকায় হজ করানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি হজ ব্যবস্থাপনাকে অস্থিতিশীল করছে। গ্রামে-গঞ্জে দালালেরা হজাত্রীদের কাছে গিয়ে বলেন, আপনাকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকায় হজ করাবো। হজ এজেন্সিতে এসে দালালেরা দুই লাখ ২০ হাজার টাকায় বুকিং দেয়। কিন্তু দেখা যায় দালালেরা হজযাত্রীর কাছ থেকে বুকিংয়ের টাকা নেওয়ার পর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে হজ প্যাকেজের সম্পূর্ণ টাকা নেয়। কিন্তু হজ এজেন্সিকে আর কোনো টাকা দেয় না।  

অনেক সময় এজেন্সির মালিক কমিশন কিংবা সুযোগ বেশি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রুপ লিডারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকাও নেয়, পরে বলে সেই টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয় এজেন্সির মালিক। এভাবে কতিপয় হজ এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের এমন দুর্নীতি-জালিয়াতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে হজ ব্যবস্থাপনা।

আমরা মনে করি, অনিয়ম-প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া এজেন্সির বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা যেন কোনো ধরনের ছাড় না পায়, সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। যেসব এজেন্সি এমন প্রতারণা করে, তাদের কঠোর দণ্ড হওয়া দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া তাদের পরিশুদ্ধতা আসবে না; নতুবা প্রতিবছর তারা অনিয়ম-প্রতারণা চালিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে টাকা দেওয়ার পরও যাদের হজযাত্রা অনিশ্চিত, তাদের কষ্ট লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে এটাই প্রত্যাশিত।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৮
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।