ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ক্রিমিয়ায় মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি (পর্ব-১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৮
ক্রিমিয়ায় মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি (পর্ব-১) ...

কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত একটি প্রাচীন মুসলিম জনপদ ক্রিমিয়া।এক সময় যা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। ক্রিমিয়া বিশ্বপরিমণ্ডলে পরিচিত ও আলোচিত ছোট্ট একটি প্রজাতন্ত্র।সোভিয়েত আমলে এটি রাশিয়ারই অংশ ছিল। বিশ শতকের ৫০ এর দশকে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি ইউক্রেনকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে এটি ইউক্রেনের থেকে দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। এর রাজধানী সিমফারোপোল।

ক্রিমিয়ার চারপাশে ঘিরে রয়েছে কৃষ্ণসাগর ও আজোভ সাগরের অথৈ জলরাশির প্রবল তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস। সে হিসেবে ক্রিমিয়াকে একটি উপদ্বীপও বলা যেতে পারে।

দক্ষিণে প্রায় আট কিলোমিটারজুড়ে ইউক্রেনের সীমানা-রেখা। পশ্চিমে রাশিয়ার কুবান অঞ্চল ও ক্রিমিয়ার মাঝে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রণালীর অবস্থান।

ক্রিমিয়ার বর্তমান আয়তন প্রায় ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। পরিবেশ-প্রকৃতি ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে একটু ভিন্নতর। শীতকালে খানিকটা উষ্ণ। আর গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক।

ক্রিমিয়াতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সুষমার বেশ সমাহার রয়েছে। রয়েছে সবুজ-শ্যামলিমাময় সমতলভূমি ও চিত্তাকর্ষক উঁচু-নিচু পাহাড়।  আঁকাবাঁকা মনোরম গিরিপথ। মনোলোভা উপত্যকা ও স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ হ্রদ আর সুপেয় পানির নদী-জাল। এসব প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দেশটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল ছোট্ট এই ভূখণ্ড।

ইউক্রেনের অংশ থাকার সময় ক্রিমিয়া ১৯৯১ সালে স্বায়ত্বশাসিত রিপাবলিকের মর্যাদা অর্জন করেছিল। বর্তমানে অঞ্চলটির  জনসংখ্যা চব্বিশ লাখের কাছাকছি। যার সিংহভাগই রুশ ভাষাভাষী সম্প্রদায়। ১৩ শতাংশের মতো রয়েছে তাতার মুসলিম নাগরিক। এই তাতার মুসলিমরা এক সময় সোভিয়েত সরকারের রোষানলে পড়ে ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তারা আবার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসে। নতুন করে শান্তি-সুখে বসবাস করতে শুরু করে।
...ইসলামের আগমন 
খ্রিস্টাব্দ দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব ও মুসলিম বণিক-পর্যটকদের মাধ্যমে ক্রিমিয়াঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। পরবর্তীকালে প্রাচ্য থেকে আগত তুর্কি বংশোদ্ভুত সাধারণ মানুষ ক্রমান্বয়ে সমাজের উচ্চ পদে আরোহন করতে থাকে। পাশাপাশি দেশে গ্রিক, রোমান, ইতালীয় বংশোদ্ভূত জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা জোরদার হওয়ার ফলে মুসলমানদের সংখ্যা গণহারে বাড়তে থাকে।

১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে মোঘলরা ক্রিমিয়ার দক্ষিণাঞ্চল জবরদখল করে সেখানে কিছুদিন তাদের ক্ষমতা বিস্তার করে। ১৩১৩-১৩৪১ সালে উজবেক শাসনামলে ক্রিমিয়া ইসলামি শাসনাভুক্ত হয়ে পড়ে।

ক্রিমিয়ান মুসলিম সম্রাটদের রাজ্য শাসন 
ক্রিমিয়ান-তাতারি ভাষার ‘ক্রম’ (ক্রিমিয়ার বর্তমান মুসলমানদের জাতীয় ভাষা) শব্দের অর্থ কেল্লা বা দুর্গ। এ নামকরণের কারণরূপে পরিদৃষ্ট হয়, ক্রিমিয়ান মুসলমানরা শত্রুর সামনে দুর্গ বা প্রাচীরের ন্যায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। তাই এ ধরনের নামকরণ করা হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্রিমিয়া আয়তনগতভাবে বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ছিল। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের সুবিস্তীর্ণ  এলাকা ও অাজোভ সাগরের দীর্ঘ জলাশয় (বর্তমানে রাশিয়ার দখলে) ক্রিমিয়ার সীমানাভুক্ত ছিলো।

‘আলহাজ কারাই প্রথম’ নামক চেঙ্গিস খানের এক পৌত্র ১৪৪১ খ্রিস্টাব্দে স্বতন্ত্রভাবে ‘ক্রিমিয়া রাজ্য’ গঠন করেন। তিনি (আলহাজ কারাই প্রথম) ভীষণ আলেম-ওলামাভক্ত ছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বেশ আন্তরিক ছিলেন। সময়ে সময়ে তাদের সর্বোচ্চ সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করে আসেন। তিনি ওসমানি খেলাফতের বিখ্যাত খলিফা ‘মুহাম্মদ আল-ফাতেহ’র সমসাময়িক ছিলেন।

১৪৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ারাজ্য ওসমানি খেলাফতের মিত্ররাষ্ট্রে পরিণত হয়। রাশিয়া, পোল্যান্ড ও মলদোভার বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে তুর্কিরা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা করে। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলাক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এ মৈত্রী সম্পর্ক টিকে ছিলো প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর।
ককেশাস, বলকান ও বর্তমান তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে ওসমানি খেলাফতের প্রতিরক্ষাসীমান্ত ছিলো ক্রিমিয়ার সরাইখানা বা পান্থশালাগুলো।

১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কালোথাবায় ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আলহাজ কারাই প্রথমের প্রায় পঞ্চাশজন বংশধর তার পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘকাল ক্রিমিয়া শাসন করে আসছিলেন।

ওসমানি খেলাফতের সুলতান সুলাইমান আল-কানুনির (১৫১৫ খৃস্টাব্দ) পিতামহ ‘মিনক্লি কারাই প্রথম’ সে শাসকবর্গের একজন ছিলেন। তিনি রাজ্যের অবকাঠামোগত অবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামগ্রিক সমৃদ্ধিতে বেশ অবদান রেখেছিলেন।

অনুরূপভাবে ‘গাযি কারাই দ্বিতীয়’ ছিলেন সৃজনশীল কবি ও বিদগ্ধ সাহিত্যিক। আলেম-ওলামাদের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো বেশ গভীর। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা ছিল তার প্রিয় বিষয়। ক্রিমিয়ার সোনালি যুগে সপ্তদশ শতাব্দীতে তিনি দেশের অন্যতম সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সে সময়ে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম পার্থসারথি হিসেবেও তিনি বিবেচিত হন। তুর্কি, ফার্সি ও আরবি ভাষায় সুপাণ্ডিত্য ছিল তার। তার সাহিত্যকর্ম ও রচনাসমগ্র ইউক্রেনি ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ১৫৯৪ সালে মস্কো দখল করে মস্কো সম্রাটকে ‘জিযয়া’ বা কর আদায়ে বাধ্য করেছিলেন।

সম্রাট ‘ইসলাম কারাই তৃতীয়’ ওসমানি খেলাফতের সীমান্ত সুসংহতকরণে এবং বহিরাগত শত্রুদের মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করেন। এটি তার মহৎ সাফল্য হিসেবে গণ্য হয়। ১৬৫৪ সালের কোনো একদিন চৌকস সমরপারদর্শী ও অদম্য সাহসী এ সম্রাট মৃত্যুবরণ করেন।

[ক্রিমিয়ায় মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাকি অংশ পরের কিস্তিতে প্রকাশিত হবে। ]

ঋণ স্বীকার:
১। সাপ্তাহিক আল-মুজতামা—কুয়েত থেকে প্রকাশিত। (সংখ্যা নং ২০৮৩, জুলাই ২০১৪ ইং)।
২। ট্রাভেলস অব  ইবনে বতুতা।
৩। ‘আল-মুনজিদ- আরবি  অভিধান ও  বিশ্বভূগোল মানচিত্র।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।