ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল আমল থেকেই ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিতি পায়। এমনকি মোগলপূর্ব যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পুরনো ঢাকায় দুটি ও মিরপুরে একটি প্রাচীন মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ইতিহাস পরম্পরা ও কালের প্রক্রিয়ায় ঢাকা মসজিদের শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। ১৮৩২ সালে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জর্জ হেনরি ওয়াল্টার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন, তৎকালীন ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৫৩টি। ধীরে ধীরে সংখ্যা আরো বাড়তে থাকায় ক্রমেই ঢাকা অসংখ্য মসজিদের শহরে পরিণত হতে থাকে।
বর্তমানে ‘মসজিদের শহর’ ঢাকায় কতটি মসজিদ আছে—তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের হিসাব মতে ঢাকায় ১০ হাজার মসজিদ রয়েছে।
ঢাকার অনেক প্রাচীন মসজিদ সময়ের পরিক্রমায় (সংস্কারের কারণে) হারিয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু এখনো সমহিমায় ইতিহাসের অংশ হয়ে টিকে রয়েছে এবং ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশি লেখক ও শিক্ষাবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেন, ঢাকার প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে সর্বপ্রাচীন মসজিদ বিবেচনা করা হয় পুরান ঢাকার বিনত বিবির মসজিদ (১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত)। বিভিন্ন সূত্রের বিবেচনায় ‘বিনত বিবির মসজিদ’ ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদ। পুরান ঢাকার ৬ নম্বর নারিন্দা রোডের সুপ্রাচীন হায়াৎ বেপারীর পুলের উত্তর দিকে ‘বিনত বিবির মসজিদ’ অবস্থিত। (ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, তৃতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি, ২০০৪)
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্যানুসারে, বিনত বিবির মসজিদ ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকায় অবস্থিত একটি মধ্যযুগীয় মসজিদ। নারিন্দা পুলের উত্তর দিকে অবস্থিত এ মসজিদটির গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে ৮৬১ হিজরি সালে (অর্থাৎ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে) সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে মারহামাতের কন্যা মুসাম্মাত বখত বিনত বিবি এটি নির্মাণ করান। এটি ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি; যা প্রায় ৬০০ বছর আগের। ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁর আগমনের প্রায় দেড়শ বছর আগে বাংলার সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের আমলে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি নির্মিত হয়।
সে সময় পারস্য উপসাগরের আশপাশের লোকজন প্রায়ই জলপথে এ অঞ্চলে বাণিজ্যে আসতেন। পুরান ঢাকার এ এলাকা (নারিন্দা-ধোলাইখাল) দিয়ে তখন বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার একটি শাখা, যা বুড়িগঙ্গা হয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশত। আরাকান আলী নামক এক সওদাগর সে সময় এ এলাকায় বাণিজ্যের জন্য আসেন এবং এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিই নামাজ পড়ার সুবিধার্থে এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
এখানে বসবাসকালীন আরাকান আলীর মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়। এ মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় এবং পরবর্তীতে আরাকান আলীর মৃত্যু ঘটলে তাকেও এখানেই কবর দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিনত বিবির নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। মসজিদের দেয়ালে প্রোথিত একটি কালো পাথরে এ ইতিহাস ফার্সি ভাষায় খোদাই করা আছে।
৮৬১ হিজরিতে নারিন্দা রোডস্থ এ মসজিদটির প্রথম সংস্করণ এবং বাংলা ১৩৩৭ সালে এ মসজিদটির দ্বিতীয় সংস্করণ ও দ্বিতীয় গম্বুজটি স্থাপন করা হয়।
প্রায় ২০০ বছর ধরে এলাকাবাসী একটি কমিটির মাধ্যমে এ মসজিদটির দেখাশোনা করে আসছেন। এলাকাবাসী ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে বর্তমানে পুরোনো ভবন ঠিক রেখে নতুন তিন তলা মসজিদ ভবন নির্মিত হয়েছে।
বাংলা পিডিয়াতে বলা হয়েছে, ‘বিনত বিবির মসজিদই ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মুসলিম-স্থাপত্য নিদর্শন ও শহরের প্রথম মসজিদ। ছয়-সাত কাঠা জায়গায় গড়ে ওঠা চার কোণবিশিষ্ট মসজিদটির আদি গঠনশৈলীতে একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ থাকলেও বাংলা ১৩৩৭ (১৯৩০ খ্রি.) সনে দ্বিতীয়বার সংস্কারকালে আরো একটি গম্বুজ যুক্ত করা হয়, যা মসজিদটির বিবর্তন ও সম্প্রসারণের স্পষ্ট ধারণা দেয়।
মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত একটি কালো পাথরে ফারসি ভাষায় লিখিত বর্ণনায় রয়েছে, সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর আমলে আরকান আলী নামক এক পারস্য সওদাগর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকার নারিন্দায় বসবাস শুরু করেন এবং তিনিই ৩০-৪০ জন মুসল্লির ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বিনত বিবির মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঢাকায় বসবাসকালেই আরকান আলীর অতি আদরের কন্যা বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং তাকে ওই মসজিদসংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। কন্যার আকস্মিক মৃত্যুর শোকে-দুঃখে পিতা আরকান আলীও ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করলে তাকেও কন্যার পাশেই ওই মসজিদসংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। অন্য একটি বর্ণনা মতে, মাহরামাতের কন্যা মুসাম্মাৎ বখত বিনত বিবি মসজিদটি নির্মাণ করান। ’ (বখত বিনত বিবি, বাংলা পিডিয়া)
মূল মসজিদটির ভেতরের আয়তন ৩.২ মিটার। দেয়ালের গভীরতা ১.৮৩ মিটার পুরু। অভ্যন্তরভাগের পরিমাপ প্রতি দিকে ৩.৬৬ মিটার করে। বর্গাকৃতির মসজিদটির পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ আছে। বর্তমানে পূর্বদিকে একটি বারান্দা যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে কোরআনের হিফজ বিভাগ চালু রয়েছে।
১৯৩০ সালে মসজিদটির প্রথম সম্প্রসারণে দক্ষিণ দিকের দেয়াল ভেঙে মূল মসজিদের সমআয়তন ও একটি গম্বুজ বৃদ্ধি করা হয়। দ্বিতীয় সম্প্রসারণ আরও ব্যাপক আকারে পশ্চিম দিকে সম্পন্ন হয়। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে।
মসজিদটির বাইরের সব দিক সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে আরেকটি গম্বুজবিশিষ্ট কক্ষ এবং পূর্ব-দক্ষিণে একটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়েছে। বারবার পুরু আস্তরণের ফলে মসজিদের পোড়ামাটির অলঙ্করণ এখন আর দেখা যায় না।
সাম্প্রতিক মূল মসজিদের পাশের মসজিদটি ৬তলা করা হয়েছে এবং সুবিশাল একটি মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের ইমাম সাহেবের তথ্য মতে, এটি পুরান ঢাকার সবচেয়ে উঁচু মিনার।
মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, অষ্টকোণা পার্শ্বস্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে খিলানের ব্যবহার, স্বাভাবিক অলঙ্করণ, বাঁকানো কার্নিশ ইত্যাদি।
মসজিদের দুটো গম্বুজের একটিতে আদি ভবন প্রতিষ্ঠার সময়কাল (৮৬১ হিজরি) লেখা আছে। আরেকটি গম্বুজের লেখা আছে, ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) মসজিদটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয়।
মসজিদ পরিচালনা কমিটি ২০০৬ সালে মসজিদের পুরান ভবনটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ কাজে হাত দেয় । সে সময় মসজিদের প্রায় অংশই ভেঙে ফেলা হয়। তবে এলাকাবাসীর বাধায় মসজিদের বারান্দাটুকু ভাঙা হয়নি। তবে মূল মসজিদের চারটি মিনারের মধ্যে দু’টি মিনারের গায়ের পলেস্তরা খসিয়ে নতুন করে প্লাস্টার করা হয়েছে। বাকি দু’টি খানিক অযত্ন ও অবহেলায় রয়েছে।
বিনত বিবি মসজিদকে নির্ভুলভাবে ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদ বিবেচনা করা কঠিন। ড. আব্দুল করিমের ‘মোগল রাজধানী ঢাকা’ বই ও আরো অনেকের মতে, ঢাকার মুগদার মাণ্ডা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ‘মাণ্ডা মসজিদ’ বিনত বিবি মসজিদের চেয়েও প্রাচীন মসজিদ। শিলালিপি অনুযায়ী ‘মাণ্ডা মসজিদ’ ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে নির্মিত। ঐতিহাসিক ‘মাণ্ডা মসজিদ’ বর্তমানে ‘নান্দু ব্যাপারী মসজিদ’ নামে পরিচিত।
চারশ বছরের পুরানো যেকোনো স্থাপনা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে সংরক্ষিত থাকার কথা। মসজিদ কমিটির একজন প্রবীণ সদস্যকে জিজ্ঞেস করা হলে, তার জানা নেই বলে জানান। মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল আজিজকে সংস্কারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জানান, তিনি নতুন এসেছেন। মূল মসজিদের সংস্কারসংক্রান্ত কিছু তিনি জানেন না।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের প্রাচীন যে অংশটুকু রক্ষিত আছে, তা সংস্কারের কারণে আর হারিয়ে যাবে না। অন্তত বর্তমানে যতটুকুর অস্তিত্ব রয়েছে, তা বহাল তবিয়তে থাকবে এবং মসজিদ-কমিটিও পুরোনো অংশটুকু টিকিয়ে রাখতে প্রয়াস পাবে।
যেভাবে যাবেন
গুলিস্তান বা সায়দাবাদ থেকে রিকশায় করে পুরান ঢাকার নারিন্দা ৬ নম্বর রোড়ে গেলেই দেখা যাবে দুই গম্বুজের সুপ্রাচীন ‘বিনত বিবি মসজিদটি’। অবশ্য দূর থেকে মসজিদের সুউচ্চ মিনার দেখেও অনেকে পৌঁছে যেতে পারবেন।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৮
এমএমইউ/এসএইচ