নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুর দূত হামলে পড়ে। অল্প ক্ষণের পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং তোমরা আমার কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে। ’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন,মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও। ’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ৭৮)
আত্মীয়-স্বজন, আপনজন কিংবা কাছের ও পরিচিত কেউ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে, মানুষ কষ্টে ব্যথাতুর হয়। তাদের স্মরণ করে প্রতিনিয়ত স্মৃতিকাতর হয়। বেদনার পলেস্তরা জমাট বাধে হৃদয়-মনে। এ বেদনা ও স্মৃতিকাতরতা থেকে জন্ম নেয়, যদি সম্ভব হয় তাদের জন্য কিছু প্রবল ইচ্ছা।
কিন্তু মৃতদের জন্য কী করা যায়? ইসলামী শরিয়ত মৃতদের স্মরণের সুন্দর ও সঠিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়, দিবস বা তারিখের অপেক্ষা করতে হয় না বা বাধ্যবাধকতাও নেই। কোনো অনুষ্ঠানে ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামেরও প্রয়োজন নেই। শরিয়ত মোতাবেক মৃতদের কীভাবে স্মরণ করা যায়, এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো—
মৃত ব্যক্তির ভালো কাজের আলোচনা
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃতদের ভালো কাজগুলোর আলোচনা করো এবং মন্দ কাজের আলোচনা থেকে বিরত থাকো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৯০০)
তাদের জন্য দোয়া-মাগফিরাত করা
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! যেদিন হিসাব প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সব ঈমানদারকে ক্ষমা করুন। ’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪১)
অন্য জায়গায় নূহ আলাইহিস সালামের এ দুআ বর্ণিত হয়েছে,‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার পিতা-মাতাকেও এবং যে ঈমান অবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে আর সমস্ত মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকেও। ’ (সুরা নুহ, আয়াত : ২৮)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমলের ফায়দা ভোগ করে—সদকায়ে জারিয়া; এমন জ্ঞান, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং ওই সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৬৩১)
তাদের সওয়াবের উদ্দেশ্যে দান-সদকা করা
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদা (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তাঁর কোনো উপকারে আসবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। সাদ (রা.) বলেন, “আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমার ‘মিখরাফ’ নামক বাগানটি আমার মায়ের জন্য সদকা করে দিলাম। ”(বুখারি, হাদিস : ২৭৫৬)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করে, আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন এবং ধন-সম্পদ রেখে গেছেন কিন্তু অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার (গোনাহের) কাফফারা হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। (মুসলিম, হাদিস নং : ১৬৩০)
মৃতদের কবর জিয়ারত করা
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি এর আগে তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন থেকে অনুমতি দিলাম, তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা তা তোমাদের দুনিয়াবিমুখ করে এবং পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৫৭১)
হাদিসে বর্ণিত কবর জিয়ারতের একটি দোয়া এরকম, (অর্থ) ‘এই কবরস্থানের বাসিন্দা মুসলিম-মুমিনদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। ইনশাআল্লাহ আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ৯৭৪)
প্রসঙ্গত আমাদের দেশে কেউ মারা গেলে তার নামে তৃতীয় দিন ‘কুলখানি’ এবং ৪০ তম দিনে ‘চল্লিশা’ নামে যে ভোজনের আয়োজন করা হয়, তা ইসলাম সমর্থন করে না। তবে কেউ যদি মৃত ব্যক্তির কাছে সওয়াব পৌঁছানের নিয়তে গরিব-দুঃখী ও অসহায়দের খাবার খাওয়ায়, তাহলে সেটা বৈধ।
কিন্তু প্রথা বানিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে যেভাবে খাবার-ভোজন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে ধনী-গরিব ও বিভিন্ন স্তরের মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অর্থসংকটসহ নানাবিধ অসুবিধা থাকলেও অনেকে সামাজিক প্রথার কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়ে এমনটি করেন। কিন্তু এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ অনুচিত ও পরিত্যাজ্য।
ইসলামী শরিয়তে—কোরআন-হাদিস ও আল্লাহর রাসুল (সা.) এর সাহাবাদের জীবনচরিতে এমন কোনো কাজ প্রমাণিত নয়। তাই এটি ইসলাম বহির্ভুত; উপরন্তু অনেকের জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য।
অনেক সময় দেখা যায়, লোক সমাগমের আধিক্য দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক ভোজনের আয়োজন করা হয়। এ ধরনের আয়োজনের খাবার খেতে আল্লাহর রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অহংকারীর খাবার গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং : ৩৭৫৪)
ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই যে, কারো মৃত্যুর পর মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে খাওয়া তো দূরের কথা—উল্টো তিন দিন মৃতের শোকাহত পরিবারের জন্য খাবার আয়োজন করার নির্দেশ করেছে ইসলাম। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩১৩৪)
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে ‘কুলখানি’, ‘চল্লিশা’ ইত্যাদির নামে উল্টো তাদের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। সমাজের নামে খাবার ও ভোজনের আয়োজন করতে স্নায়ুভাবে তাদের বাধ্য করা হয়। হাদিসে জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা [রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে] মৃত ব্যক্তির বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা ও খাদ্যায়োজনকে (শরিয়তনিষিদ্ধ) মাতম বলে গণ্য করতাম। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ৬৮৬৬, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৬১২)
অতএব, মৃতের বাড়িতে শুধু খাবারের আয়োজন ও ভোজনপর্ব নয়, বরং তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা, তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া মুমিনের কাজ। তাই সাধ্য মোতাবেক মৃতের পরিবারকে সহযোগিতা করা ও মৃতের সওয়াবে জন্য কিছু আমল ও কাজ করা অপরিহার্য। প্রথাসর্বস্ব আয়োজন ও অপচয় থেকে বেঁচে থাকাও ইসলামে কাম্য। আল্লাহ আমাদের উত্তম কাজে তাওফিক দান করুন।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
এমএমইউ