ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

সভা-মাহফিল ও অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারে সংযম-সতর্কতা জরুরি

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৯
সভা-মাহফিল ও অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারে সংযম-সতর্কতা জরুরি

যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সভা, বিনোদন-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রচারণা ও ধর্মীয় ওয়াজ-আলোচনার সাউন্ড মূল অনুষ্ঠানস্থলে সীমাবদ্ধ রাখাই যৌক্তিক। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে মাইক লাগিয়ে অন্যদের শুনতে বাধ্য করা অন্যায়, অনৈতিক ও অযৌক্তিক। কারণ এতে আপামর জনগণ কষ্ট পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের উপাদান
ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এটি মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা।

ইসলামের শুরু থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। এমনকি ইসলামপূর্ব কালেও যুগে যুগে মনীষী ও পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে জনসাধারণের প্রতি ওয়াজ-নসিহতের বিষয়টি পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন লোকমান তার পুত্রকে ওয়াজ (উপদেশ) করতে গিয়ে বলল, হে পুত্র আমার! আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহা অপরাধ। ’ (সুরা লোকমান, আয়াত: ১৩)

ওয়াজ ও নসিহতের এ কল্যাণধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত উম্মতের আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও যুগ, স্বভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনে এতে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান অবধি তা অব্যাহত আছে এবং থাকাও অপরিহার্য। বর্তমানে তাতে কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এর মৌলিক গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনি ভাইয়েরা যদি কিছু বিচ্যুতির সংশোধনের প্রতি খেয়াল করেন, তাহলে এর উপকারিতা আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে।

সভা, অনুষ্ঠান ও মাহফিলে মাইকের ব্যবহার
সভাস্থলে প্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার কাম্য। দূর-দূরান্তে ও বাজার-ঘাটে অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এতে শরিয়তবিরোধী অনেক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যেমন—নামাজির নামাজে ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত হয়, অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট হয়। বিভিন্ন বৈধ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাজে ও মনোযোগে ব্যাঘাত হয়।

মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হয়, এমন জোরে কোরআন তেলাওয়াতকেও ফিকাহবিদরা অবৈধ বলেছেন। (ফাতহুল কদির ১/২৯৮, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ৩/৫৫২, জিকর ও ফিকির, পৃষ্ঠা ২৬)

.

উমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করে, এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হতো, তাই তিনি উমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে ওমর (রা.) ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে ওমর (রা.) এসে তাকে শাস্তি দেন। ’ (আখবারু মাদিনা : ১/১৫)

ওয়াজ-মাহফিলের আশপাশে মাইকের ব্যবহার
ওয়াজ-মাহফিলে প্যান্ডেলের বাইরে মাইক ব্যবহার না করাই ভালো। কেউ করলেও বড়জোর রাত ১০টা পর্যন্ত চালু থাকতে পারে; এর বেশি কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের মাইক ব্যবহারের কারণে অন্য ধর্মের অনুসারী কিংবা ঘুমন্ত মানুষ, শিশু, অসুস্থ লোক এবং বিশেষ করে পিএসসি ও জেএসসি-সহ অন্যান্য পরিক্ষার্থী; এমনকি মাহফিলের আশপাশের মানুষদের জরুরি প্রয়োজনে মোবাইলে কথাবার্তা বলাও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। কারো ক্ষতি করে, কাউকে কষ্ট দিয়ে এভাবে ইসলাম প্রচার কোনোভাবেই ইসলামে অনুমোদিত নয়। এমন অযৌক্তিক কাজে বহু সাধারণ মানুষ বরং ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবেন; বরং হচ্ছেন।

কেউ কষ্ট পাবে এমন স্বরে ক্বিরাত পড়তে রাসুল (সা.)-এর নিষেধ 
রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ইতিকাফ-কালে সাহাবিদের উচ্চস্বরে ক্বিরাত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন, ‘জেনে রাখো! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে চুপিসারে আলাপে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে ক্বিরাতে বা সালাতে আওয়াজ উঁচু করো না। ’ (আবু দাউদ, সালাত অধ্যায়, হাদিস: ১৩৩২)

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, তুমি প্রতি জুমআয় লোকদের হাদিস শোনাবে। যদি এতে তুমি ক্লান্ত না হও তবে সপ্তাহে দুইবার। আরও অধিক করতে চাও তবে তিনবার। আরও অধিক নসিহত করে এই কোরআনের প্রতি মানুষের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করো না। লোকেরা তাদের কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তুমি তাদের কাছে এসে তাদের নির্দেশ দেবে, আমি যেন এমন হালাতে তোমাকে না পাই। কারণ এতে তাদের কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং তারা বিরক্ত হবে। বরং তুমি এ সময় নীরব থাকবে। যদি তারা আগ্রহ নিয়ে তোমাকে নসিহত দিতে বলে তাহলে তুমি তাদের নসিহত দেবে। (বুখারি, হাদিস: ৬৩৩৭)

মাইক ব্যবহার নিয়ে বিশিষ্টজনের অভিমত
বিশিষ্ট সাংবাদিক, সমাজচিন্তক ও ইসলামী গবেষক-আলোচক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ‘ধর্মীয় কাজেও মাইক ব্যবহারে সংযম খুবই জরুরি’ শিরোনামে বাংলানিউজে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন, ‘ইসলামে এমন বিধান রয়েছে, নামাজের জামাতে ইমাম সাহেব সবচেয়ে বয়স্ক ও দুর্বল ব্যক্তিটির প্রতি লক্ষ্য করে নামাজ আদায় করবেন। ইসলামে জোরে মাইক লাগিয়ে কোরআন শরিফ শবিনা পড়া আলেমরা সমর্থন করেন না। কারণ, কোরআন পড়ার সময় নীরবে মন লাগিয়ে তা শোনা শ্রোতাদের ওপর ওয়াজিব। নির্দিষ্ট জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে সমবেত মুসলমান ছাড়া দুনিয়ার নানা কাজে ব্যস্ত মুসলিমদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তাছাড়া সারারাত উচ্চশব্দে কোরআন পাঠ করলে তা কোনো রুগী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, বৈধ সম্পর্কে লিপ্ত, বিষণ্ণ, নিদ্রামগ্ন, বৃদ্ধ, শিশু বা অন্য মানুষের জন্য ‘বিরক্তি বা বিব্রতকর’ হওয়া অসম্ভব নয়। ফলে তারা কেউ যদি কোরআনের বিরুদ্ধে কোনো অসতর্ক উক্তি করে বসে তাহলে তাদের যেমন গোনাহ হবে, ক্ষেত্রবিশেষ ইমানও নষ্ট হতে পারে। এমনিভাবে শরীয়তবিরোধী এমন উপস্থাপনার জন্য এর উদ্যোক্তারাও গুনাহের ভাগি হবেন। ’

মোবাইল ব্যবহারের মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে দেশে-বিদেশে বহু আলেম এখন কিতাব লিখেছেন। বাংলাদেশেও বহু বই লেখা হয়েছে। মাইকের ব্যবহার নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা হয়ে থাকে। তারপরও বহুলোক ইলম-জ্ঞান না থাকার কারণে মাইক ব্যবহারের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা পালন করতে পারে না।

মানুষকে কষ্ট দেওয়া কাজ ইসলামে অনুমোদিত নয়
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী আরও লেখেন, মানুষের কষ্ট হয় এমন কোনো আয়োজন ইসলামি শরিয়ত কোনোদিন সমর্থন করেনি। ভবিষ্যতে কোনো দিন করবেও না। নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত ও শরিয়তের জনকল্যাণমূলক নীতি এসব বিষয়ে পরিমিতি সংযম ও শান্তির পক্ষে। একজন হৃদরোগীর কষ্ট বিবেচনা করে, কয়েকজন পরীক্ষার্থীর অসুবিধা বিবেচনা করে সভা-অনুষ্ঠানে মাইকের নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে।

মাইক ব্যবহার নিয়ে দেশের শীর্ষ আলেমদের অসন্তোষ
দেশের শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই আমার সঙ্গে এপ্রসঙ্গে কথা বলার সময় ‘সারারাত মাহফিল’ ও ‘অতিরিক্ত মাইক’ নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মসজিদ, হেফজখানা, মাদরাসা, স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা বিবেচনা না করে গায়ের জোরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, বিভিন্ন দিবস পালন করা এদেশে রেওয়াজ আছে বটে—তবে ধর্মের ব্যাপারে যেন এমন অসাবধানতা কেউ না করতে পারে, এ ব্যাপারে সমাজের সচেতন ব্যক্তি, ওলামায়ে কেরাম, ইমাম-খতিব সাহেবরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। ’

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। বিষয়ভিত্তিক লেখা ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।